দুর্নীতি বেড়েছে

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে আমরা যে এক কদমও এগোতে পারিনি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনই তার প্রমাণ। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত সংস্থাটির ধারণাসূচক ২০১৮-এ দেখা যায়, বাংলাদেশ ১০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে মাত্র ২৬। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪৯তম। আগের বছর ২৮ নম্বর পেয়ে কিঞ্চিৎ এগিয়ে ছিল। ভারত ১০০ নম্বরে পেয়েছে ৪১ এবং পাকিস্তান ৩৩। ১৮০টি দেশের মধ্যে ডেনমার্ক প্রথম অবস্থানে আছে। ১০ নম্বর পেয়ে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ (১৮০তম) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সুদান। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচ বছর বাংলাদেশও সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত ছিল।

২০০৫ থেকে এ পর্যন্ত আমাদের অগ্রগতি খুবই সামান্য। নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন, দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে বলে নাকি দুর্নীতিও বেড়েছে। এটি হাস্যকর যুক্তি। ভারতের অর্থনীতি তো বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণ বেশি। চীনের অর্থনীতি আরও বড়। তারা কীভাবে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরল?

উদ্বেগের কথা হলো দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আমাদের নিচে আছে শুধু আফগানিস্তান। ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল তো বটেই, এমনকি যেই পাকিস্তানের চেয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবসম্পদ ও প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশে অনেক এগিয়ে, সেই পাকিস্তানও আমাদের ওপরে আছে। এটি বাংলাদেশের জন্য লজ্জাজনক। নির্বাচনের পর নতুন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানোর কথা বলছে, মন্ত্রীরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানা মন্তব্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে চুনোপুঁটি দুর্নীতিবাজেরা মাঝেমধ্যে ধরা পড়লেও অনেক ক্ষেত্রেই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর বড় দুর্নীতিবাজ বা অর্থ লোপাটকারীদের যে সরকার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না, তার প্রমাণ ব্যাংকিং খাত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কেরানির দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধানই বলে দেয় সরকারের সেবা খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে। ভূমি-নদী-জলাশয় দখল, সরকারি ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কারণে যে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে, তাও ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান টিআইয়ের প্রতিবেদনের যথার্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও তিনি প্রতিবেদনটি পুরোপুরি নাকচ করে দেননি। সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে ব্যবসায়ী বিনিয়োগকারী, বিভিন্ন খাতের গবেষক ও বিশ্লেষকদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে সূচক তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু হয়নি।

দুদকের চেয়ারম্যান যখন টিআইয়ের কাছে দুর্নীতির তথ্য–প্রমাণ চেয়েছেন তখনই গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। গত ১১ বছরের পাচারের পরিমাণ ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে কি না, সেটি পরখ করতে টিআই বা জিএফআইয়ের প্রতিবেদন পড়ার প্রয়োজন পড়ে না। দেশের সাধারণ মানুষ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে সেবাপ্রার্থীরা তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে টের পাচ্ছেন।

গতবার টিআইয়ের ধারণাসূচকে বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়ে ছিল বলে দুদক চেয়ারম্যান স্বাগত জানিয়েছিলেন। এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। টিআইয়ের প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন না তুলে দুদকের উচিত রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও করার শক্তি ও সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা করা। শুধু অতীতের বা ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করা সহজ কাজ। বর্তমানের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে সেটাই হবে আসল সাহসের কাজ। তেমন কিছু করে দেখাতে পারলেই দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা সম্ভব হবে।