দুর্ভোগ এবং শিক্ষা নিয়ে ভাবনা

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে ২ ফেব্রুয়ারি। পরীক্ষাকে নিশ্ছিদ্র করার জন্য আমাদের আয়োজনের শেষ নেই। সব কোচিং সেন্টার বন্ধ ঘোষণার পর আর কী কী করা হবে কে জানে! ফেসবুকসহ যত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রয়েছে তা বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। বন্ধ হতে পারে ইন্টারনেট। পরীক্ষা কেন্দ্রের ত্রিসীমানায় কিংবা তার বাইরে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ হতে পারে, কাছে হাসপাতাল থাকলে এবং সেখানে মোবাইল ফোন জীবন বাঁচানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্র হলেও।

আমরা জানি কয়েক বছর আগেও আমাদের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারির আকার ধারণ করেছিল। সুখের বিষয় এই যে গত দুটি পাবলিক পরীক্ষায় এমনটি হয়নি, পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন। তবে এখনো কেন জানি মনে হয় মূল সমস্যাটি আমরা অন্যান্য দেশের মতো সমাধান করতে পারছি না। এই পরীক্ষাকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমাদের জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে। একটি সমস্যা সমাধানে যদি অন্য ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করা হয়, তাহলে সমাধানটি টেকসই হয় না, গ্রহণযোগ্য হয় না।

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণের উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটেছিল বিচার বিভাগীয় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে। নানা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট থেকে প্রতীয়মান হয় যে কোচিং সেন্টারগুলোকে যেভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, বাস্তবে সংশ্লিষ্টতার ততটা প্রমাণ মেলেনি। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকাণ্ডেই কিন্তু কোচিং সেন্টারের সংশ্লিষ্ট কাউকে দায়িত্ব প্রদান করার কথা না। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন শিক্ষকেরা, মডারেশন করেন শিক্ষকেরা, টাইপ করা, ছাপানো, কেন্দ্রে প্রেরণ—এর কোনো কিছুতেই কোচিং সেন্টারের লোকজনের সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা নয়। কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছানোর দায়িত্বও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের করার কথা। হয়তো প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তার অভাবে কখনো কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকেরা কেন্দ্রে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মোটের ওপর কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছানো পর্যন্ত কোচিং সেন্টারগুলোর কোনো ভূমিকা নেই। তারপর পরীক্ষার খাতা পরীক্ষকদের মধ্যে বিতরণ, নম্বর প্রদানসহ আরও যত কর্মকাণ্ড আছে, তাতেও তাদের সম্পৃক্ততা নেই। তাহলে তাদের কেন বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে?

আমরা যদি মনে করি কোচিং সেন্টারগুলো ছেলেমেয়েদের কিছু বুলি শেখাচ্ছে, কিছু বোঝাচ্ছে না তাহলে আমরা যথাযথ প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে, যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি কেন? বাস্তবতা হচ্ছে এখনো প্রকৌশল কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রসহ কর্মসংস্থানের সুবিধাসম্পন্ন সব বিষয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জনকারী সিংহভাগ ছাত্র কোচিং সেন্টারে যায়। এ অবস্থায় ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্র কিংবা তাদের অভিভাবকেরা কোচিং সেন্টারে না যাওয়ার বিষয়টি মানবেন কেন? আমার মধ্যে এ রকম শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে শিক্ষার্থীদের যদি স্কুল–কলেজের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা না হয়, তাহলে তারা কোচিং সেন্টারেই যাবে। আমাদের যে পাঠ্যপুস্তক, প্রশ্নপত্রের ধরন, স্কুল–কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষকদের বেতনকাঠামো, সামাজিক মর্যাদা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির চাপের যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার কোচিং এবং নোট বইয়ের বিস্তার।

শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ যদি ৫০ টাকা হয়, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি বিনিয়োগ সম্ভবত তার থেকে কম নয়। এমনকি উন্নত দেশেও কোচিং সেন্টারের সদর্প উপস্থিতি রয়েছে। কোরিয়া, জাপান, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে কোচিং শুধু চলছেই না, তার বিস্তারও ঘটছে। এসব দেশের স্কুল–কলেজগুলো শিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক, ল্যাবরেটরি দিয়ে অনেক সমৃদ্ধ। আমরা কীভাবে ভাবতে পারি যে আমাদের দেশ কোচিংমুক্ত হবে? আমরা কি তার জন্য শিক্ষায় যোগ্য বরাদ্দ দিচ্ছি, আমাদের স্কুল–কলেজের পাঠদান কি শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য যথেষ্ট? একে তো পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব, তারপর সেই বরাদ্দের অর্থ থেকে যদি কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়, ফটোকপি মেশিনের দোকানের ওপর নজরদারি রাখতে হয়, তাহলে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা হবে।

শিক্ষা নিয়ে, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের অনেক পরীক্ষণ হয়েছে, সম্ভবত মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষণ হয়েছে, পরীক্ষা পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন করে পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এত পরীক্ষণের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমরা অনেক গবেষণা করব, ২০ বছরে একবার পরিবর্তন করব। প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষায় আমাদের ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান কিংবা শিক্ষার অন্যান্য শাখার ভিত্তি মজবুত করব। শিক্ষা সারা জীবনের জন্য। আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্ররা অত্যন্ত ব্যুৎপত্তির সঙ্গে ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতে পারে, যদিও তাদের সিলেবাসে সম্ভবত ইনস্যুরেন্স শব্দটির উল্লেখ থাকে না, রসায়নশাস্ত্রে পাস করে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছে, আমাদের প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদসহ নানা বিষয়ের স্নাতকেরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনে কাজ করছে। সুতরাং অহরহ সিলেবাস কিংবা পরীক্ষার ধরন পরিবর্তন করে গোটা জাতিকে অস্বস্তিতে ফেলার কোনো প্রয়োজন নেই, সাময়িক সমাধানের বৃত্ত থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে চাই।

কোচিং সেন্টারের প্রতি গোটা সমাজের আগ্রহ থেকে বুঝতে হবে আমাদের স্কুল–কলেজে পড়ালেখায় ঘাটতি রয়েছে, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। যত দিন এই সমস্যাগুলোর যথেষ্ট ভালোভাবে মোকাবিলা করতে না পারছি, তত দিন এর বিকল্প সমাধানের কথা ভাবতে হবে। যেমন খুব ভালো মানের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে, প্রয়োজনে চার–পাঁচ বছর সময় দিয়ে। ভালো শিক্ষকদের পাঠদান থেকে যাতে সারা দেশের ছাত্রছাত্রী উপকৃত হতে পারে তার জন্য টিভি চ্যানেল ব্যবহার করা যেতে পারে এবং তাতে রীতিমতো সময়সূচি করে নানা বিষয়ের, নানা শ্রেণির পাঠদান করানো যেতে পারে; যা থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ছাত্ররা উপকৃত হতে পারে, সঙ্গে শিক্ষকেরাও।

প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য লটারি সিস্টেম প্রবর্তন করায় সরকারকে সাধুবাদ জানাই। তবে এই পদ্ধতিকে আরও কার্যকর করার জন্য কলেজে যেমন অনলাইনে ভর্তি হচ্ছে, সেই পদ্ধতি আমরা প্রতিটি শহরের জন্য, বিশেষ করে মহানগরগুলোর জন্য সমন্বিতভাবে করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্র এবং অভিভাবকদের যে ভোগান্তি, তাতে দেশের, জাতির যে ক্ষতি তার থেকেও জাতি মুক্তি আশা করে। জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিনা ভর্তি পরীক্ষায় আমাদের ছাত্রদের ভর্তি করছে আর আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের ভর্তির জন্য তাদের কত ভোগান্তি পোহাতে বাধ্য করছি। স্যাট স্কোরের মতো একটি ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত অথবা একই রকম বিষয়ে ভর্তির জন্য মাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির ব্যবস্থা করা উচিত।

খুবই ভালো হতো স্কুল–কলেজের পড়ালেখাটাই যদি ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট হতো, চিত্তবিনোদন ও খেলাধুলার জন্য আমাদের তরুণ–কিশোরদের পর্যাপ্ত সময় থাকত। ধনতন্ত্র আমাদের জীবনে যেমন নানা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে, একই সঙ্গে যত্রতত্র প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতাও সৃষ্টি করেছে; যার সবকিছু সুস্থ নয়। বিশ্বব্যাপী এই প্রতিযোগিতাকে না বলার মতো বিত্তবৈভব আমাদের নেই। সুতরাং আমরা বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে গেছি। এখন আমরা যা করতে পারি তা হলো, এই প্রতিযোগিতাগুলোকে জাতি গঠনের কল্যাণে ব্যবহার করা। সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও তৈরি করতে পারছে না; যদিও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী বিল গেটসের লাইনে দাঁড়িয়ে বার্গার কেনার সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত দৃশ্যটি আমাদের সবাইকে ওই রকম একটি সমাজ গড়তে উদ্বুদ্ধ করছে। আমাদের কোটিপতিদের ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা, বাসস্থান কিংবা খাদ্যের মান নিশ্চয়ই সাধারণ নাগরিকের ছেলেমেয়েদের মতো নয়। এটা আমরা মেনে নিচ্ছি। তাহলে কীভাবে ভাবতে পারি কোটিপতি তার ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য মাসে মাত্রই দুই শ টাকা ব্যয় করবে? এই ব্যবধান কৃত্রিমভাবে ঘোচানো সম্ভব নয়, একমাত্র উপায় সমাজের অসমতা যতটা দূর করা যায়। আর যত দিন দূর করা যাচ্ছে না, তত দিন আমাদের স্কুল-কলেজের পড়ালেখার মান বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে।

পরিশেষে আশা করি আসন্ন এসএসসি পরীক্ষা নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হবে, আমাদের পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা গত বছরের মতো কিংবা তার থেকে একটি ভালো পরীক্ষার প্রত্যাশায় থাকবেন, উদ্বেগের মধ্যে কাটাবেন না, পরীক্ষার্থীরা প্রশ্নপত্র পাওয়ার আশায় নয়, প্রস্তুতি নিয়েই পরীক্ষা দেবে।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক