প্রতিদিন এত মৃত্যু, কে দেবে কৈফিয়ত?

পরিবারের সবাই, দুই ভাইবোন, শিশু; এমন সব শিরোনামে মৃত্যুর সংবাদ আসে প্রতিদিন। ছবিতে কুমিল্লায় একসঙ্গে নিহত ইটভাটার শ্রমিকদের অকালপরিণতির দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।   ছবি: প্রথম আলো
পরিবারের সবাই, দুই ভাইবোন, শিশু; এমন সব শিরোনামে মৃত্যুর সংবাদ আসে প্রতিদিন। ছবিতে কুমিল্লায় একসঙ্গে নিহত ইটভাটার শ্রমিকদের অকালপরিণতির দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো

২৩ জানুয়ারি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। পদ্মা সেতুতে সেদিন সপ্তম স্প্যান বসানো হয়। এই উজ্জ্বল–চকচকে আনন্দের খবরের সঙ্গে আরেকটি গতানুগতিক, ‘সাধারণ’ খবরও সংবাদমাধ্যমে সেদিন এসেছিল; সেটি লক্ষ্মীপুরে সাতজনের মৃত্যুর। একই পরিবারের ছয়জনসহ সাতজন মানুষ সেদিন ট্রাকচাপায় মৃত্যুবরণ করে।

খবরটি অভিনব কিছু নয়। প্রতিদিনই সড়কে মৃত্যুর এমন খবর থাকে। পরিসংখ্যানের গড় হিসাবে কেবল আজকের দিনটিতেই বাংলাদেশে গড়ে ২০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায়।

এসব ঘূর্ণিতেই মনে থাকে না যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচ কয়েক দফায় বেড়ে যখন ৩০ হাজার কোটির ঘরে পৌঁছেছে, তখন এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়েও বেশি—৪০ হাজার কোটি টাকা। আমরা শুধু এক বছরেই সড়কে জীবন দিয়ে কিংবা পঙ্গু হয়ে, শুধে চলেছি একেকটি পদ্মা সেতুর প্রাক্কলিত সর্বশেষ ব্যয় থেকেও ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি

সাড়ে তিন বছরে ২৫ হাজার মৃত্যুর সঙ্গে আরও ৬৩ হাজার মানুষ শারীরিকভাবে হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। এসবের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মরছে শিশু, তরুণ, উপার্জনক্ষম অংশ। আর ঢাকায় শুধু যানজটেই রোজ ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা।

বিবিধ ক্ষতির এসব পরিসংখ্যান আরও দীর্ঘ। কিন্তু ১ কিংবা ১ হাজার কিংবা ১০ হাজার মৃত্যুতেও যাদের ঘুমের কোনো ব্যাঘাত হয় না, কমতি পড়ে না হাসির রেখায়, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ ও ‘অধিক জনগুরুত্বপূর্ণ’ দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত সেই রাজনীতিকদের এসব মামুলি পরিসংখ্যান দেখিয়ে কী হবে!

তার চেয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার সময়, মা বাচ্চাকে বুকে আঁকড়ে ধরে রাস্তা পার হওয়ার সময়, ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হওয়ার সময়, কোনো যানবাহন না পেয়ে বাসের পাদানিতে ঝুলতে বাধ্য হওয়ার সময়, ইটভাটার ঘুমঘরে ঘুমানোর সময়, একমুখী লেনে শুধু একদিকে তাকিয়ে রাস্তা পেরোনোর সময়, স্কুলে যেতে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময়—সব ধরনের কাজে আমরা নিজেদের কপালকে দায়ী করতে থাকি। কারণ, জীবনকে হাতের মুঠোয় পুরে, যুদ্ধে যাওয়ার চেয়েও ভয়াবহ অনিশ্চয়তা নিয়ে আমরা, এ দেশের মানুষেরা, রোজ রাস্তায় নামি।

না, এটা তো বুলগেরিয়া নয় যে এমন কোনো দায়বোধ হবে! সে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। আর শুধু ঈদের ছুটি কাটাতে গিয়েই অন্তত ৩৩৯ জন রাস্তায় মরি আমরা। গদি তবু অক্ষয় থাকে। যুদ্ধের জন্য আফগানিস্তান কিংবা ইরাকে যত মানুষ মরেছে, তার বেশি পোকামাকড়ের মতো মরে এখানকার রাস্তায়, বলছিলেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিচালক সংবাদমাধ্যমকে। 

এমনিভাবে চলতে চলতে এক আগস্টে তারেক মাসুদকে আমরা হারিয়েছিলাম। চার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ-আদেশ কতটুকু পূরণ করেছে তাঁর সন্তান, স্ত্রী কিংবা বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতি সে হিসাব শিকেয় তোলা থাক। এমন অনেক কান্না আকিফা, রাজীব, মিম, সিহাবুল, আফিফাদের মা, স্বজনেরা রোজ এখানে কেঁদে চলেছেন।

এই কান্নার জ্বলুনি বারবার ঘষা খেয়ে ব্যথাবোধ নষ্ট হওয়া আমাদের জরাগ্রস্ত চামড়ায় কিছুই না হলেও আরেক আগস্টে জাগিয়ে তুলেছিল অসংখ্য কিশোরকে। তারপর তো ইতিহাস। ঘরে তাদের ফেরানো হয়েছে—আর তারা দেখছে আশ্বাসগুলো মিথ্যে ছিল। তারা ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসেছে বিশৃঙ্খল সড়ক, অব্যবস্থাপনা—এক অকল্পনীয় নিত্যমৃত্যুর দেশে। না, এখানে কোনো গৃহযুদ্ধ চলছে না, বোমা মারছে না অন্য দেশ। তবু এখানে বেশুমার মৃত্যুর মিছিল

কিছুই বদলায়নি। অথচ সারা দেশের ৪ শতাংশ জায়গা অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত, যেখানে সারা বছর দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। ঢাকা শহরে পথচারীদের জন্য ৫৪টি বিপজ্জনক চত্বর চিহ্নিত রয়েছে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত ২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বুয়েট অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ২১ লাখ যানবাহনের জন্য ফিটনেস পরিদর্শক আছেন মাত্র ৪১ জন। একই সাক্ষাৎকারে দুর্ঘটনার জন্য অন্যতম দায়ী অসম গতির যানবাহন একই রাস্তায় চালানোর বিষয়টি বছরের পর বছর চালু থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি। মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ যে সড়কে বিশৃঙ্খলা, তাও মনে করিয়ে দেন।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ১০ লাখ পেশাদার চালকের অভাব রয়েছে দেশে। মোটরযান আইন অনুযায়ী, পেশাদার চালক আট ঘণ্টার বেশি প্রতিদিন গাড়ি চালাবেন না এবং একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি চালাবেন না। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে, ৪২ সেকেন্ডে ফিটনেস সনদ পেয়েছে একেকটি গাড়ি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এই সনদ দিচ্ছে। এই চালকেরা এবং এই ৪২ সেকেন্ডে রাস্তায় চলার সনদ পাওয়া গাড়ি যখন রাস্তায় নেমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, মায়ের অপেক্ষায় থাকা শিশু আর ঘুমন্ত মানুষদের হত্যা করবে, তখন তার দায় কার? পরিবহন বাণিজ্য বন্ধ করা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ত্রুটিপূর্ণ জায়গাগুলোয় বিকল্প তৈরি—এগুলোর জন্য এপর্যন্ত কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো কি না জানা বিষয়? ১৭ কোটি মানুষের দাবির চেয়ে, জীবনের চেয়ে কিসের প্রতি, কোন বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি দায়বদ্ধতাবশত এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারছে?

এসব অসংগতি আমাদের সরকার কি জানে না? চট্টগ্রামে এরই মধ্যে চার র‍্যাম্পের বরাদ্দে দুই র‍্যাম্পের ফ্লাইওভার চালু হয়ে গেল। এত তাড়া কেন? মগবাজার ফ্লাইওভারের মতো বিতর্কিত উদ্যোগ জ্যাম কমিয়েছে, নাকি আরও জটিল করেছে, সে আলোচনা চলছে এবং এরই মধ্যে সিঙ্গাপুর, আমেরিকা ইত্যাদি নানান জাতের উন্নয়ন চাষ হচ্ছে। মধ্য আয়ের দেশ, ইত্যাদি ইত্যাদি। আয় ‘বাড়ছে’, তবে আয়ু নাই হয়ে যাচ্ছে। 

ভয়াবহ রাস্তা দিনরাত্রি মাথা খারাপ করে দিলে পরস্পরকে আমরা দোষারোপ দিতে থাকি—পথচারী মোটরগাড়ি চালককে, বাসচালক সাইকেলচালক–রিকশাচালককে, ট্রাক–বাসের সহযাত্রী আরেক সহযাত্রীকে। যদিও এই দুষ্টচক্র বিশৃঙ্খল সড়কেরই অবদান। আর আমরা যখন পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকি, আঙুল তুলতে থাকি নিজেদেরই দিকে, তখন নষ্ট দেবতাদের খুব আনন্দ হয়।

তাঁরা আরও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন। কারণ, এ দেশে এমন রাজনীতিক আর অবশিষ্ট নেই, নিজ দেশের একজন মানুষের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে যাঁর ঘুম নষ্ট হয়, গ্লানিতে মুখে কথা ফোটে না।

তাঁরা কি খুব বেশি নিশ্চিত হয়ে গেছেন, এভাবে চলতে থাকলে কোনো সমস্যা নেই—কোথাও কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না কখনো?

নুসরৎ নওরিন: লেখক ও সাংবাদিক