আসুন, জেগে উঠি বাংলায়

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম গত শুক্রবার। প্রধান বক্তা ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক তিনি, পুরো বক্তৃতায় একটা শব্দও ইংরেজিতে বললেন না। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারদের কাছে এই শিক্ষাটা আমরা পেয়ে আসছি। আমাদের ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান ছিল খুবই জনপ্রিয়—জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাতে বিচারক থাকতেন, কখনোবা আসতেন সভাপতি হয়ে; তাঁরা আমাদের শিখিয়েছিলেন যখন বাংলায় বলবে, পুরোটাই বাংলায় বলবে, বাক্যের মধ্যে অকারণে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। তাতে নম্বর কাটা যাবে।

আজকাল বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে উৎসব কিংবা আয়োজনের ডাক পাই। হয়তো বিজ্ঞান মেলা হচ্ছে, হয়তো ভাষা নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেসবের নাম দেওয়া হয় ইংরেজিতে—সায়েন্স ফেস্ট, ল্যাঙ্গুয়েজ ফেস্ট, ডিবেট ফেস্ট। অথচ স্কুল বা কলেজটা বাংলা মাধ্যমেরই। অনুষ্ঠান হচ্ছেও বাংলায়। চারদিকে ইংরেজিতে লেখা পোস্টার–ব্যানার ঝুলছে। যে স্মরণিকাটা প্রকাশ করা হয়েছে, তা–ও ইংরেজিতে।

ইংরেজি যে আমাদের শিখতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্য এক বা একাধিক ভাষা শেখা তো ভালো।

বাংলাদেশের জাতীয় উন্নতিতে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের কজন ইংরেজি মাধ্যম থেকে পড়ে এসেছেন? সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই হোন, ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদ কিংবা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস হোন; প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক থেকে শুরু করে এনভয় গ্রুপের কুতুবউদ্দীন আহমেদ হোন। মাশরাফি বিন মুর্তজা থেকে শুরু করে সাকিব আল হাসান—আপনি যেকোনো নাম নিতে পারেন। বিদেশে পড়তে গিয়ে যাঁরা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এম জাহিদ হাসান, যিনি আইনস্টাইনের গবেষণাগারে কাজ করে চলেছেন সুনামের সঙ্গে; অভিকর্ষ তরঙ্গ গবেষক দলের দুই বাঙালি দীপঙ্কর তালুকদার কিংবা সেলিম শাহরিয়ার—এঁদের প্রত্যেকেই বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছেন। হ্যাঁ, ইংরেজি জানতে হবে, এঁরা সবাই নিশ্চয়ই খুব ভালো ইংরেজি জানেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের বেশির ভাগ পণ্ডিত, গবেষক, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, যাঁরা দেশ–বিদেশে খুব ভালো করছেন, তাঁরা প্রায় সবাই উঠে এসেছেন বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয় থেকে। এখনো আমাদের যে তরুণ শিক্ষার্থীরা গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো করে আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে, তারাও প্রায় সবাই বাংলা মাধ্যম থেকেই আসা।

মহিউদ্দিন আহমদের লেখা এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল বই থেকে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারির একটা ঘটনা তুলে ধরি। তিনি লিখেছেন, ‘২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা কলেজের নর্থ হোস্টেল থেকে আমরা সাত-আটজন লাঠিসোঁটা নিয়ে নিউমার্কেটে যাই। মার্কেট বন্ধ, গেট ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকি। আমাদের লক্ষ্য ইংরেজি ও উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা। বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ছিল ইংরেজিতে। কতগুলো নিয়ন সাইনে সাজানো, যথেষ্ট খরচ করে এগুলো বানানো হয়েছে। লাঠির নির্মম আঘাতে সব তছনছ হতে থাকে।’

১৯৬৯-এ বাঙালি জাতীয়তাবাদী জোশ এ রকমই প্রবল ছিল। আমরা স্কুলে যাই স্বাধীনতার পরে। আমরাও প্রবলভাবে বাংলাপ্রেমের জোয়ারে ভাসছিলাম। ইংরেজি শেখায় গুরুত্ব দিইনি। জেলা শহরের স্কুল-কলেজে এবং জীবনযাপনে ইংরেজির কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না; টেলিভিশন ছিল না; বইয়ে পড়লাম ‘স্যান্ডউইচ’, তার মানে কী, কেউ বলতে পারছিলেন না। ইংরেজি ক্লাসে বদলি স্যার এসে ‘দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই’ গল্পটার নাম পড়লেন ‘গিফট অব দ্য ম্যাগি।’ এই জন্যই প্রবাদ আছে, যখন কেউ কোনো শব্দ উচ্চারণে ভুল করে, তখন তাকে নিয়ে হাসাহাসি কোরো না; এর মানে হলো সে নিজে নিজে বই পড়ে শব্দটা শিখেছে।

আমাদের ওই ইংরেজিবিদ্বেষের ফল ভালো হয়নি। আমাদের ওই প্রজন্মই এখন জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন; আমাদের অনেকেই ভালো করে ইংরেজি জানি না। সেটা ভালো কথা নয়। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলা মাধ্যমের ছাত্র ছিলেন; কিন্তু তাঁর ইংরেজি হাতের লেখাও কত সুন্দর।

কিন্তু এখন দেশে ইংরেজির যে জোয়ার জেগেছে, তার ভেতরে একটা মেকিত্ব আছে। আমাদের শিক্ষার মান পড়ে গেছে। স্কুল-কলেজে আমরা শিক্ষার্থীদের ভালো করে না শেখাচ্ছি বাংলা, না শেখাচ্ছি ইংরেজি। কিন্তু বাংলা ব্যাপারটাকে এখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের ভাষার মতো করে ভাবতে শেখানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তারই নমুনা হলো বাংলা মাধ্যমের স্কুলে-কলেজে সাহিত্য নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে, ভাষা নিয়ে অনুষ্ঠান হলে সেসবের নামকরণ করা হচ্ছে ইংরেজিতে; প্রকাশনা সব করা হচ্ছে ইংরেজিতে। একদিন একটা পাঁচতারা হোটেলে সারা দেশ থেকে তরুণ শিক্ষার্থীদের এক সমাবেশে গেছি। তাঁদের, ধরা যাক, এইচআইভি-এইডস নিয়ে সচেতন করা হবে। একজন মাত্র বিদেশি উপস্থিত, যিনি দাতা সংস্থা থেকে এসেছেন। সবাই অতিকষ্টে ইংরেজিতে বক্তব্য দিচ্ছেন ওই একজনের জন্য। তরুণেরা সব উসখুস করছেন, মোবাইল টিপছেন, নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন। একজন ডোনারের জন্য পুরো অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যই তো মাঠে মারা যাচ্ছে। যাঁদের উদ্দেশে কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা কেউই শুনছেন না। আমি দাঁড়িয়ে বাংলায় বলা শুরু করলাম, তরুণেরা নড়েচড়ে বসলেন।

মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার পক্ষে এই ২০১৯ সালে এসে কথা বলতে হবে, এটা অকল্পনীয়। চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন—সব দেশ এগিয়ে গেল তাদের ভাষার মধ্য দিয়ে। আমরা না শিখলাম বাংলা, না শিখলাম ইংরেজি।

আমাদের দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা যে অর্থনীতিতে ভালো করছি, আমরা যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছি, ধান-ফল-মাছ উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড করছি, এর সবই হচ্ছে যাঁরা শুধু বাংলায় কথা বলতে পারেন, সেই সব মানুষের অবদানের কারণে। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছিলেন, ‘আমরা কি যাব না তাদের কাছে, যারা শুধু বাংলায় কথা বলে!’

আসুন, আমরা জেগে উঠি। আসুন, আমরা বাংলার জোয়ার সৃষ্টি করি। আসুন, আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মের মনে এই আত্মবিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিই যে বাংলায় চলা বাংলায় বলা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের কাজ নয়; বরং তারাই এই দেশকে সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়। যে কোটি কোটি ছেলেমেয়ে সারা দেশ থেকে বাংলা মাধ্যমে পড়ে উঠে আসছে, তারাই এই দেশের ভবিষ্যৎ।

১৯১২ সালে ইংল্যান্ডের কবি ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা করছিলেন এক অনুষ্ঠানে; তার জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আপনাদের ভাষার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে; কিন্তু বাংলা ভাষা আমাকে ছাড় দেয় না, সে-ভাষা আমার সকল নিবেদনের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য চায়। তার দাবির কাছে আমি সানন্দে আত্মসমর্পণ করেছি; না-করে উপায় ছিল না।’ (অনুবাদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)

বাংলা ভাষা আমাদেরও ছাড় দেবে না, আমাদের সব নিবেদনের ওপর বাংলা ভাষা একচ্ছত্র আধিপত্য চায়। মাতৃভাষা মানে তো মায়ের ভাষা নয়। মাতৃভাষা মানে যিনিই মা, তিনিই ভাষা। ভাষা আমাদের মা। আমাদের মায়ের মুখ আজ মলিন। আমাদের আজ নয়নজলে ভাসার দিন।

বাংলা ভাষার প্রসারে, প্রচারে, শিক্ষায়, প্রচলনে আমাদের আরেকবার জেগে উঠতে হবে, বলতে হবে, ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়।’

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক