নতুন সংসদের যাত্রা

গত ৩০ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হলো। শক্তিশালী কোনো বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে এই সংসদের চেহারা কেমন, তা এখনই বলা যাবে না। জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক হিসেবে নির্বাচন করেছে, কিন্তু এ দলের সাংসদেরা বিরোধী দলের আসনে বসছেন; বিরোধী দলের নেতা ও উপনেতা নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের নির্বাচনের আগের ও পরের ভূমিকা পরস্পরবিরোধী। নির্বাচনের আগে তাঁরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াই চালিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে আসন ছেড়ে দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের আওয়ামী লীগ বাদে অন্য দলগুলোর সাংসদদের অবস্থানও পরিষ্কার নয়। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম অধিবেশনে বলেছেন, সংসদে তাঁদের অবস্থান নিয়ে তাঁরা বিব্রত। জাতীয় পার্টি দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচন করেছে, কিন্তু ১৪ দলের শরিকেরা নৌকা প্রতীক নিয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং তাঁরা জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে নৌকার সহযাত্রীদের এই পরস্পরবিরোধী ভূমিকা সংবিধানের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ কি না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, ১৪ দলের শরিকেরা বিরোধী দলের আসনেই বসবেন।

জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকাই পালন করবে। একই সঙ্গে তিনি সরকারি দলের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁদের ন্যায্য কথা যেন আমলে নেওয়া হয়। জবাবে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা স্পিকারের কাছে সরকার ও বিরোধী দলকে সমান সুযোগ দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু সংসদীয় কার্যক্রম সুযোগ দেওয়া বা নেওয়ার বিষয় নয়। সংসদ চলতে হবে আইন ও কার্যবিধি অনুযায়ী।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র এখনো টেকসই হয়নি, যদিও আমরা স্বাধীনতার ৪৭ বছর ও ১০টি সংসদ পার হয়ে এসেছি। পূর্বতন সংসদের চেয়ে পরবর্তী সংসদ অধিকতর কার্যকর হয়েছে, এ রকম উদাহরণ কম। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর যে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখন নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

অতীতের কথা বাদ দিলেও নবম ও দশম সংসদেও আইনগুলো পাস হয়েছে অর্থবহ আলোচনা ছাড়াই। নবম সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস হয়েছে কয়েক মিনিটের আলোচনায়। আর দশম সংসদে ‘কার্যকর’ বিরোধী দল না থাকায় শুধু আইন পাস নয়, সবকিছুতে বিনা বাধায় ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে। সংসদে যাঁরা বিরোধী দলের সাংসদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ মন্ত্রী হয়েছেন। একসঙ্গে মন্ত্রী ও বিরোধী দলের সাংসদ থাকা যায় না।

এই বাস্তবতায় একাদশ সংসদে কার কী ভূমিকা হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটজন সাংসদ এখনো শপথ নেননি। ইতিমধ্যে তাঁরা বর্তমান সংসদ বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। তাঁরা যদি শেষ পর্যন্ত শপথ না নেন, তাহলে
একাদশ সংসদ নির্বাচনকালীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোটের’ মধ্যেই সীমিত থাকবে।

সংসদীয় গণতন্ত্র তখনই কার্যকর ও টেকসই করা সম্ভব হয়, যখন সরকার ও সংসদ আলাদা থাকে। রাষ্ট্রের এই দুটি অঙ্গ একাকার হয়ে গেলে তা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হয়। অনেক দেশে সরকারি দলের সাংসদেরা সরকারের অনেক বিল বা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে থাকেন। কিন্তু আমাদের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ জুড়ে দেওয়ায় সেটি অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যে জাতীয় সংসদ জনগণের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করে থাকে, সেই সংসদ কেন সাংসদদের মুখ বন্ধ রাখার বিধানটি বহাল রাখবে?

আইনপ্রণেতারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাববেন আশা করি।