জিরো টলারেন্স থেকে মাইনাসে নামুন

জিরো টলারেন্স কথাটি বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর আগে আমরা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা শুনেছি। এখন যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি। আমাদের মনে আছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, মন্ত্রী-সচিবেরা সৎ হলে ৫০ শতাংশ দুর্নীতি কমে যাবে। এবার নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া তাঁর প্রথম ভাষণে দুর্নীতিগ্রস্তদের ‘শোধরানোর’ আহ্বান জানিয়েছেন। দুর্নীতি উচ্ছেদের সংকল্পের পাশাপাশি তিনি স্বীকার করেছেন যে দুর্নীতি নিয়ে সমাজে অস্বস্তি রয়েছে।


টিআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চার ধাপ অবনতির খবরে আমরা তাই বিস্ময় দেখি না। দুদক–কর্তা যদিও ‘মুখের কথার নম্বর’ মানতে চাননি। নাকচ করার সুরে টিআইবির কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়েছেন। একটি সূচক বলি। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে দুদকের মামলায় মোট নিষ্পত্তির হার ছিল ১৪ শতাংশ। ২০১৮–তে ৭ ধাপ অবনতি ঘটেছে। অথচ এই সময়ে মামলা বেড়েছে ৪ গুণের বেশি।


এবারের মন্ত্রিসভার নতুন মন্ত্রীদের মুখে আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানা কথা শুনছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ‘১০০ দিনের কর্মসূচিতে’ দুর্নীতিগ্রস্ত কাউকেই সরকার রেহাই দেবে না বলে মন্তব্য করেছেন। নতুন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী কোনো দুর্নীতি প্রশ্রয় না দেওয়ার কথা বলেছেন। ভূমিতে দুর্নীতির ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি ভূমিমন্ত্রী। তিনি ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী চেয়েছেন। ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে যে শুধু কর্মচারীদেরই সম্পদের হিসাব নেওয়া হচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী অর্থ প্রতিমন্ত্রী থাকতে কী করেছিলেন, সেই তথ্য প্রকাশ না করে বলেন, এখন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা কোনো ছাড় পাবেন না, ‘চরম শাস্তির’ মুখোমুখি হতে হবে। তার মানে এতকাল কি তাঁরা জ্ঞাতসারে ‘ছাড়’ পেয়েছেন। রাজউকসহ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব প্রতিষ্ঠানকে অবশ্য ‘সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত’ করার ঘোষণা দিয়েছেন নয়া গণপূর্তমন্ত্রী। রেলমন্ত্রী এতটুকু অনিয়ম ছাড় না দেওয়ার কথা বলেছেন। পরিবেশমন্ত্রী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রীর মুখেও শোনা গেছে একই সংকল্পের কথা। আর দুদকের চেয়ারম্যান সবাইকে টপকে গেছেন। এখন ‘দুর্নীতির গন্ধ’ পেলেই তিনি ব্যবস্থা নেবেন।


বর্তমান শতাব্দীর শুরুতেই বাংলাদেশ দুর্নীতিতে টানা পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার এতকাল পরে ২০১৯ সালে এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা শুনছি। তাহলে এত দিন কোন নীতি ছিল? আর সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ আমাদের কী দিয়েছে? কিছু সাফল্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তা কতটা? এবং কী মূল্যে তা পেয়েছি?


যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক শেল্ডন ওয়েন জিরো টলারেন্স সম্পর্কে বলেন, লোকজনকে ‘জিরো টলারেন্স পলিসি’ অনুসরণের কথা বলাটাই একটা ‘জিরো টলারেন্স ফ্যালাসি’। তার মানে, জিরো টলারেন্স শুধু মুখেই বলা, কাজের বেলায় একটা ফাঁকি। কিন্তু আমরা তো দুর্নীতি দমন নিয়ে আর কোনো ফাঁকি দেখতে চাই না, খাঁটি কিছু দেখতে চাই।


এবারের নির্বাচনের আগে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত ‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা’ অনুষ্ঠানে এক তরুণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, বাংলাদেশ কবে দুর্নীতিমুক্ত হবে? জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এটা আমার লক্ষ্য আছে। আমি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরপর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হবে।’


১৭ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট একটি নির্দেশনা যেতে হবে—কেউ দুর্নীতি করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’ এখন মন্ত্রিসভা বিভাগের উচিত এই ঘোষণার আলোকে উপযুক্ত পরিপত্র জারি করা। শুধু তা–ই নয়, কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত নিয়মিত আমজনতাকে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় মনে হচ্ছে, ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।


সাধারণভাবে একটা কথা বলা হয়, অভাবে স্বভাব নষ্ট। পুলিশ বা সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন কেউ কেউ যুক্তি দেন, তাঁদের জীবন নির্বাহ করা কঠিন, তাঁরা ঠেকায় পড়ে দুর্নীতি করেন। এটা খোঁড়া যুক্তি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা এত বেশি বাড়িয়েছে যে দুর্নীতি করার প্রয়োজন নেই। তিনি মানুষের মানসিকতা বদলের ওপর জোর দিয়েছেন।


মানসিকতা নিশ্চয়ই বদলাতে হবে, কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সাহসিকতার পরিচয় দেওয়ার বিষয়টি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য ও ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। ‘ক্রসফায়ারে’ দুই শতাধিক মৃত্যুর পর এখন মাদক কারবারিরা আত্মসমর্পণের সুযোগ পাচ্ছেন। এই আত্মসমর্পণ কী সুফল দেবে? উপরন্তু, সমাজে বার্তাটা কী যাচ্ছে? ইয়াবা–বাণিজ্যের ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে অভিযুক্ত বর্তমান সরকারের তালিকাভুক্ত একজন সাবেক সাংসদকেই কেন ‘সমন্বয়ক’ হিসেবে দেখা যাবে? আবার কেউ বলতে পারেন, মাদক অপরাধীরা আত্মসমর্পণের সমসুযোগ পেলে ‘দুর্নীতিগ্রস্তরা’ কেন পাবেন না?


জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সততা-আন্তরিকতা নিয়ে জনসেবা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার হৃদয় হলো জনপ্রশাসন।’ কেউ দ্বিমত করবেন না। দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে জনপ্রশাসনের বা সরকারি খাতের দুর্নীতি দমন করাই মূল চ্যালেঞ্জ। দুদক–কর্তা কীভাবে গত ২৯ জানুয়ারি বললেন, দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করার মতো কোনো আইন সংসদে হয়নি, সেটা আমাদের মাথায় ঢোকে না। কারণ, গত বছর গৃহীত ‘সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮’-এ দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের দুটি রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দুদক কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না এবং এক বছরের বেশি এমনকি কারও মৃত্যুদণ্ডের সাজা হলেও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত হবেন না। এসব বিতর্কিত বিধান নির্বাচনের আগে করা হয়েছিল। এমন বিধান বহাল রেখে শুধু বেতন-ভাতা বাড়িয়ে ‘মন–মানসিকতার’ পরিবর্তন করা যাবে বলে মনে হয় না। সবকিছুর আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক জবাবদিহি। কেউ কেউ মনে করেন, নতুন মন্ত্রিসভায় পুরোনোদের অনেকের বাদ পড়ার একটা কারণ ‘দুর্নীতি’। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ ভাবমূর্তি নিয়েও কেউ কেউ নতুন করে সাংসদ ও মন্ত্রী হয়েছেন।


কোনো মন্ত্রী দুর্নীতি করলে তাঁকে শুধু সসম্মানে সরিয়ে দেওয়াই তো আইনের শাসন নয়। গত ১০ বছরে সচিবালয়ে কর্মরত যুগ্ম সচিবের ওপরে কোনো কর্মকর্তাকে দুর্নীতির দায়ে শাস্তি পেতে দেখা যায়নি। এক-এগারোর পরে দুর্নীতির দায়ে কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিচার ও সাজা হয়নি। পদ্ধতিগতভাবে দুর্বল করে রাখা দুদকের প্রসিকিউশন টিমকে অতীতের আসামিদের নিয়ে গলদঘর্ম দেখা যাচ্ছে, কিন্তু চলমান দুর্নীতির ব্যাপারে তারা কী করছে? আমরা এর আগে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে হম্বিতম্বি শুনেছিলাম, তা–ও এক-এগারোর ফসল। প্রতিপক্ষ ছিল টার্গেট। এরপর এখানে কোনো অগ্রগতি নেই।


এত বড় বড় ব্যাংক লুট, রিজার্ভ চুরি হলো, ১০ বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচারসহ পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস–সংক্রান্ত খবরগুলো একদম যাচাই হলো না। অথচ এর সঙ্গে রাজনৈতিক জবাবদিহির প্রশ্ন জড়িত। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী হাইকোর্টে খালাস পেয়েছেন। দুদক আপিল করছে না। উপহার মামলায় তিন বছর দণ্ডিত ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ হু মু এরশাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের খালাস আদেশের বিরুদ্ধে দুদকের আপিল প্রস্তুতি দোলায়মান।
আমরা দুর্নীতিতে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন। দুর্নীতি দমনের চেষ্টায় একটা মধ্যম স্তরের মর্যাদা পেতে ৪৩.১ পেতে হবে। গত এক দশকে বাংলাদেশ ২৪ থেকে ২৮-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। দক্ষিণ এশিয়াতেও আফগানিস্তানের পরে সব থেকে খারাপ অবস্থায় যে দেশটি, সেটি বাংলাদেশ। আমাদের মুখ উজ্জ্বল হবে কবে?


অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু জিরো টলারেন্সের ঘোষণায় কাজ হবে না। ঠিক এই শব্দ দ্বারা না হলেও ২০০৮ সাল থেকেই সরকারের ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে’ ছিল দুর্নীতি দমন। এতে কাজ হয়নি। দুর্নীতিবিরোধী সহনশীলতাকে কি তাহলে মাইনাসে নামাতে হবে?


মাইনাসে নামাতে হলে তিনটি শর্ত মুখ্য মনে করি। প্রথমত, ব্যাংক কেলেঙ্কারির বিচারগুলো দ্রুত শেষ করা। সোনালী ব্যাংকের হল–মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় কিছু লোকের শাস্তি হয়েছে। জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারির মামলায় কিছু লোকের সাজা হলেও তার আগেই তাঁরা পালিয়ে গেছেন। যাঁরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, তাঁরা বিচার এড়াতে পেরেছেন বলে মনে হয়। বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংক বড় উদাহরণ। আবার কলঙ্ক মোচনে ফারমার্স ব্যাংক রূপান্তরিত হলো পদ্মায়। এই কেলেঙ্কারিতে বিতর্কিত একজন রাজনীতিকের নাম এলেও দুদকের এজাহারে ঢুকল না।


কী পরিহাস! সম্প্রতি এক–এগারোর আলোচিত আমলা ‘বনের রাজা’র সাজা চূড়ান্ত হলো। আর রাজনীতিক নাজমুল হুদার আপিলের অনুমতি মঞ্জুর হলো। তাই তাঁর সাজাটা ঝুলেই থাকল।
দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মচারীদের ওই রক্ষাকবচ বাতিল করুন। নতুন মন্ত্রীরা চেনা-অচেনা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরে নেতৃত্ব দিন।
তৃতীয়ত, ডিজিটাল আইন থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ভয় পাইয়ে দেওয়া বিধানাবলি সরান।