মাহাথিরের শাসনে উন্নয়ন

মাহাথির মোহাম্মদ
মাহাথির মোহাম্মদ

শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে মালয়েশিয়ার আবির্ভাব ঘটে ১৯৮০ দশকেই। একসময় বিশ্বের ১৭ নম্বর ধনী দেশ বলে পরিচিত ছিল। মাহাথির যেদিন মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, সেদিন দেশটি ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র। তখন তার মাথাপিছু আয় ছিল ১৩০ ডলার। জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ২৫ শতাংশ। শিক্ষিতের হার ছিল ২০ শতাংশ। জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ ছিল শহরবাসী ও শিল্পনির্ভর। মাহাথির যেদিন ক্ষমতা ছাড়েন, সেদিন দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল ৩ হাজার ৩৩০ ডলার। শিক্ষিতের হার ৯৯ শতাংশ। পুরুষদের গড় আয়ু ৭১ বছর, নারীদের ৭৬ বছর। কিন্তু তাঁর এই উন্নয়ন সমালোচনার বাইরে ছিল না। মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা নব্বইয়ের দশকেই মনে করেন, সেখানে সরকার অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিস্বার্থ বিবেচনায়। সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্তৃত্বকারী দল ও কর্তৃত্বকারী রাজনৈতিক জোটের সমর্থকসহ সব রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। এটা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, স্বজনপ্রীতি এবং তহবিল আত্মসাৎ—এসবের প্রচুর সুযোগ সৃষ্টি করে। ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি সৃষ্টি হতে থাকে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য।

মাহাথিরের সময়ের উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি যুক্ত ছিল, কথাটি সত্য। মাহাথির সর্বদাই চেয়েছেন মালয়েশিয়াকে রাষ্ট্র হিসেবে দ্রুত একটি সম্মানজনক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে যেতে। তিনি সে জন্য সব সময় যোগ্য লোকদের খুঁজে নিয়েছেন। তিনি ১৯৮৪ সালে দাইম জয়নুদ্দিনকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। তিনি দাইমের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে জানতেন। দাইম মাহাথিরের ভগ্নিপতির বন্ধু ছিলেন। ফলে মাহাথির দাইমকে অর্থমন্ত্রী করে স্বজনপ্রীতি করেছেন, এ রকম অভিযোগও উঠতে পারে। দাইম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগে মালয়েশিয়ার অর্থনীতি ছিল খুবই দুর্বল, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মালয়েশিয়ার অর্থনীতির অগ্রগতি শুরু হয়। তাঁর সময় থেকে ব্যক্তিগত মালিকানা গুরুত্ব পেয়েছিল। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে এমনকি ১৯৮৫ সালে মালয়েশিয়ার বিকাশ প্রক্রিয়া ছিল ঋণাত্মক, শূন্যের ১ দশমিক ৬ নিচে। কিন্তু ১৯৮৬ সাল থেকে তা ক্রমশ ধনাত্মকভাবে বাড়তে থাকে। প্রথমে ধীরগতিতে, ১৯৮৭ থেকে অত্যন্ত দ্রুত। ১৯৮৮ সালে উন্নতির সূচক ছিল ৮ দশমিক ৯, আর পরের বছর ৯ দশমিক ২। দাইম মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের বিকাশ বিরাট ভূমিকা রাখেন। আগে যেসব ব্যাংক লোকসান দিচ্ছিল, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেসব ব্যাংকও লাভ করতে শুরু করে। তিনি ব্যাংকগুলোকে পুরোনো বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে সুষ্ঠু একটি পরিবেশে ফিরিয়ে আনেন।

দাইম মন্ত্রী হওয়ার আগেই মালয়দের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিলেন। মাহাথিরের আমন্ত্রণেই তিনি বাণিজ্য ছেড়ে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি মালয়েশিয়াকে যতই উন্নতির শিখরে নিয়ে যান না কেন, দুর্নীতির পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। দাইম তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগে আত্মপক্ষ সমর্থন না করে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। সত্য যে তিনি তাঁর পরিচিতজনদের ক্ষমতার বিভিন্ন জায়গায় বসিয়েছিলেন বা ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে দেখলেন, অযোগ্যরা মালয়েশিয়ার উন্নতি হতে দিচ্ছে না, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পরিচিত, আস্থাভাজন ও দক্ষ লোকদের বিভিন্ন দায়িত্বশীল জায়গায় বসিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে তাঁরা তাঁর খুব কাছের লোক ছিলেন।

মাহাথির লিখেছেন, মালয়েশিয়ার উন্নয়নে দাইমের অবদান অনেক। যাঁরা মালয়েশিয়ার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছেন, তাঁদের দায়িত্বশীল জায়গাগুলোতে বসানোর জন্য দাইম স্বজনপ্রীতির দায়ে অভিযুক্ত হন। স্বজনপ্রীতি যে হয়েছিল তা অস্বীকার করার উপায় দাইমের ছিল না। তাই তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন না করে পদত্যাগ করতে চাইলেন। বৃহত্তর স্বার্থে মাহাথিরের কিছুই বলার ছিল না। মাহাথির লিখেছেন, ‘কখনো কি আমি কাউকে বলতে পারি, তুমি যাদের ভালো চেনো না, যাদের যোগ্যতা সম্পর্কে ভালো জানো না, যারা তোমার বিশ্বস্ত বা আস্থাভাজন নয়, তাদের সরকারের ক্ষমতায় বসিয়ে দাও?’

আত্মীয়স্বজন, দলের আস্থাভাজন লোকদের বড় বড় কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মাহাথিরের নীতি ছিল এ রকম: এই সুবিধাটা দেওয়া হবে মাত্র একবার। এবং কাজ পাওয়ার পর তিনটা দায়িত্ব অবশ্যই পালন করতে হবে। ১. নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা; ২. ব্যয় না বাড়ানো; এবং ৩. কাজের উন্নত গুণগত মান নিশ্চিত করা। মাহাথির ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সমন্বয় সাধনকারী দল’ গঠন করে প্রতিটি প্রকল্পের কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সমন্বয় সাধনকারী দল সর্বদাই ঠিকাদারদের ওপর নজর রাখত এবং দুর্বল পরিকল্পনাগুলো সংশোধন করে দিত। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তিন মাস পরপর কাজের প্রতিবেদন দিতে হতো। ঘাটতি বা বিলম্ব দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বা মন্ত্রীর ডাক পড়ত। লালফিতার বাধাবিপত্তি দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ তা দূর করা হতো।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমলাদের দ্বারা এসব কাজ নিয়ন্ত্রিত হতো। সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পর প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের নিরপেক্ষতা ও আমলাতন্ত্রের সততা ছিল প্রধান দুটি উপাদান। মাহাথিরের বক্তব্য ছিল, অযোগ্যতার কোনো স্থান থাকবে না, প্রতিটি প্রকল্প অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই পেশাদারির ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুযোগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার অপব্যবহার চলবে না। বিভিন্ন প্রকল্পের বাজেটের ওপর সংসদ বা রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণ কমানোর জন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সব সরকারি হিসাবের অবশ্যই অডিট হবে এবং অডিটর জেনারেল সেসবের অডিট প্রতিবেদন পাঠাতে বাধ্য থাকবেন। সরকারি অর্থ সংসদ বা রাজ্য আইনসভার অনুমোদিত কাজের পেছনেই ব্যয় করা হয়েছে কি না তা দেখাও অডিটর জেনারেলের দায়িত্ব। তিনি তা স্বাধীনভাবে করবেন, রাজনৈতিক নেতারা তাঁর ওপর কোনো খবরদারি করতে পারবেন না। বলা হয়েছিল, অডিটর জেনারেল ও তাঁর কার্যালয়ের অন্য কর্মকর্তারা প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এবং প্রতিটি রাজ্য সরকারের সব হিসাব ও নথিপত্র তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করবেন। পক্ষপাতহীনতা রক্ষার জন্য তিনি পরবর্তী সময়ে বিচারকের পদ ছাড়া আর কোনো পদে নিয়োগ পেতেন না।

রাহমান চৌধুরী : গবেষক