'বাংলাদেশভীতি' যখন রাজনৈতিক পণ্য

আসামে ‘বাংলাদেশি’ খুঁজতে ইতিমধ্যে খসড়া নাগরিকপঞ্জি হয়েছে। ফাইল ছবি
আসামে ‘বাংলাদেশি’ খুঁজতে ইতিমধ্যে খসড়া নাগরিকপঞ্জি হয়েছে। ফাইল ছবি

বিজেপির আসন যেভাবে ৫ থেকে ৬১ হলো

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল শ্রীনিবাস কুমার সিনহা আসামে গভর্নর ছিলেন ১৯৯৭ থেকে পরবর্তী ছয় বছর। আসামের জাতিগত সংকটের বাংলাদেশীকরণ বিশেষ গতি পায় ওই সময়। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে তিনি রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনকে ৪২ পৃষ্ঠার এক চিঠি লেখেন। সেখানে ‘অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান’দের আসাম থেকে তাড়ানো এবং সীমান্তে কাঁটাতারের প্রস্তাব করা হয়। তাঁর দাবি, সে সময়ই আসামে ৪০ লাখ ‘বাংলাদেশি’ ছিল। অসমিয়া তরুণেরা অবশ্য বলছিলেন প্রায় ৮০ লাখের কথা।

আরেক গভর্নর জেনারেল অজয় সিং ২০০৫ সালে দাবি করেন, প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার ‘বাংলাদেশি’ আসাম রাজ্যে ঢুকছে। জেনারেল সিং পরে তাঁর দাবি কিছুটা সংশোধন করেন। তবে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় তাতে ছেদ পড়েনি। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরেক সেনাপ্রধান বিক্রম সিংও আসামের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে অভিহিত করেন। জেনারেল সিং যখন এসব বলছিলেন, তখন আসামে নির্বাচনী প্রচার চলছিল। বিক্রম সিংয়ের সঙ্গে মিল রেখেই বিজেপি নির্বাচনে ‘বাংলাদেশি’দের প্রধান ইস্যু করে তোলে। তাতে দলটির আসন আগের নির্বাচনের
৫ থেকে ৬১-তে উন্নীত হয়। কংগ্রেসের আসন নেমে আসে ৮১ থেকে ২৬-এ।

একই সময়ে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য বাংলাদেশ থেকে ট্রানজিটসহ বিভিন্ন যোগাযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিতে পারছিল। আসামে ‘বাংলাদেশভীতি’র রাজনীতি বিজেপি সরকারের জন্য বাংলাদেশে সমস্যা হয়নি, আবার আসামেও সাফল্য পেয়েছে। তবে আসামে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি থাকার দাবি বাস্তবতার সঙ্গে যেমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তেমনি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত। নির্বাচনের আগে বারবার বলা হচ্ছিল, অবৈধ অনুপ্রবেশে আসামের জনবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, রাজনীতি ও ক্ষমতা ‘বাংলাদেশি মুসলমান’দের হাতে চলে যাবে। কিন্তু যেমনটি দাবি করা হচ্ছিল, ছয় হাজার করে বিদেশি প্রতিদিন আসামে ঢুকলে ২০ বছরে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৪ কোটি ৩৮ লাখ। অথচ সর্বশেষ শুমারিতে আসামের মোট জনসংখ্যাই হলো ৩ কোটি ১২ লাখ।

আসামের জনবিন্যাস পাল্টাচ্ছে ‘বাংলাদেশিরা’?

ব্রিটিশ শাসনামলে আসামের প্রথম জনশুমারির পর দেখা যায় (১৮৭৪) সেখানে মুসলমান ২৯ শতাংশ। আর ভারতের সর্বশেষ জনশুমারিতে (২০১১) আসামে মুসলমানদের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশ। উপরিউক্ত দুই শুমারিতে আসামে হিন্দুদের সংখ্যা যথাক্রমে ৫৪ ও ৬১ শতাংশ। কোনো সম্প্রদায়ের সংখ্যাতেই বড় ধরনের উত্থান-পতন লক্ষ করা যায় না। তাতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কল্পকাহিনিগুলোতে চিড় ধরেনি সামান্যও।

আসামে ‘বাংলাদেশি’ খুঁজতে ইতিমধ্যে খসড়া নাগরিকপঞ্জি হয়েছে। এতে অনাগরিক শনাক্ত হয়েছে ৪০ লাখ। কিন্তু সাবেক সামরিক জেনারেল গভর্নর ও বিজেপির নেতারা যেমনটি ভেবেছিলেন, হুবহু তা ঘটেনি। অনাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠই দেখা যাচ্ছে হিন্দুধর্মাবলম্বী। ফলে বাংলাদেশি মুসলমানদের দ্বারা জনবিন্যাস পরিবর্তনের ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কিন্তু পরিস্থিতি থেকে সাম্প্রদায়িক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা থেমে নেই। নাগরিকপঞ্জির মাধ্যমে সৃষ্ট অনাগরিকদের মধ্য থেকে কেবল অমুসলিমদের ভারতে রাখার ইচ্ছা থেকে বিজেপি এখন নাগরিকত্ব আইন সংশোধনে উদ্যোগী। এ নিয়ে আবার উত্তর-পূর্ব ভারত তুমুল আন্দোলনে নেমেছে।

আসামের গত কয়েক দশকের এসব ঘটনাবলির বিস্ময়কর দিক হলো, এ বিষয়ে বাংলাদেশের নীরবতা। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিয়মিত যখন ‘বাংলাদেশি’ প্রবেশের কল্পিত হিসাব দিয়ে যান, তখন ঢাকায় সে সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে না।

উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে বাংলাদেশ

জনপদ থেকে জনপদে অনুপ্রবেশের মূলে কাজ করে জীবনযাত্রার মানের তারতম্য। আসামের সঙ্গে তুলনা করলে মানব উন্নয়নের অধিকাংশ মৌলিক সূচকে (এইচডিআই) বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। মাতৃমৃত্যুর হার আসামে বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণ। লাখে ৩২৮। নবজাতকের মৃত্যুও আসামে প্রায় দ্বিগুণ। সেখানে বেঁচে থাকার গড় সর্বোচ্চ বয়স ৬২ বছর। বাংলাদেশে তা ৭৯। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৭০০ ডলার, আসামে তা ১ হাজারের নিচে। এসব তথ্য-উপাত্ত কোনোভাবেই বাংলাদেশ থেকে দলে দলে মানুষের আসাম যাওয়া সমর্থন করে না।

তারপরও বাংলাদেশিদের উপচে পড়া ভিড়ের প্রচারণায় বিশেষ গতি দেওয়া হয় আসামের ১৯৭১ ও ১৯৯১ সালের শুমারি তথ্যের তুলনা দিয়ে। এই দুই শুমারিতে দেখা যায়, ২০ বছরের ব্যবধানে হিন্দুদের প্রবৃদ্ধির হার ৪২ শতাংশ, আর মুসলমানদের প্রবৃদ্ধির হার ৭৭ শতাংশ। এ তথ্য নিয়ে প্রচারমাধ্যমে শত শত প্রতিবেদন হয়েছে। বলা হয়, আসামে মুসলমানদের এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের কারণে ঘটেছে। মুসলমানদের ‘অতিরিক্ত’ বৃদ্ধির ঘটনা নিয়ে প্রচারমাধ্যমে হইচইয়ের পর অনেক গবেষণা হয়েছে এ নিয়ে। তাতে দেখা গেছে, মুসলমান এবং (শিডিউল কাস্টদেরও) বৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা। এসব কারণে জন্মের হার যে বাড়ে, সেটা জনসংখ্যাতত্ত্ব-সমর্থিত। দারিদ্র্যের সঙ্গে জন্মহার বেশির সম্পর্ক সরাসরি। যেমন আসামে ধুবড়িতে মুসলমানদের হিস্যা সবচেয়ে বেশি। সেখানে সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ। অথচ পুরো আসামে ৬৪ শতাংশ। প্রসঙ্গত, ভারতে মুসলমান ১৪-১৫ শতাংশ হলেও জমির মালিকানা তাদের হাতে মাত্র ২ শতাংশ। চাকরিতেও তাদের হিস্যা অনুরূপ। দারিদ্র্য ও অশিক্ষার এই চক্র অধিক জন্মহারকে উৎসাহিত করছে। তারপরও প্রায় ৪০ বছর যাবৎ আসামে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশই দায়ী হচ্ছে।

বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার পেছেন

আসামে ‘বাংলাদেশি’ তাড়াতে আন্দোলন ১৯৭৯ থেকে। সর্বশেষ ২০১৮-এর নাগরিকপঞ্জিতে চিহ্নিত ৪০ লাখ অনাগরিকের মধ্যে মুসলমান ১২ থেকে ১৫ লাখের মতো। চূড়ান্ত বাছাইয়ে এই সংখ্যা আরও কমবে। তার মানে, ৪০ বছর ধরে কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান’দের বিরুদ্ধে যে সামাজিক যুদ্ধ চলছে, তাদের সংখ্যা রাজ্যটির জনসংখ্যার ৫ শতাংশেরও কম। ১২০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে তাদের সংখ্যা দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

প্রকৃতপক্ষে আসামসহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি আড়াল করতেই বাংলাদেশভীতি এবং মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ার গল্প ছড়ানো হয়। এ ছাড়া আসামে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে রাখতেও এটা করা হয়। জনসংখ্যায় এক-তৃতীয়াংশ হলেও লোকসভায় আসামের ১৪টি আসনে মুসলমান এমপি কেবল দুজন। তবু আসামের সৌভাগ্য বলতে হবে। কারণ, ভারতের অন্তত ২২ রাজ্য থেকে লোকসভায় কোনো মুসলমান এমপিই নেই। এ মুহূর্তে কেন্দ্রের মতোই আসামেও বিজেপি ক্ষমতায়। ১২৬ আসনের বিধানসভায় তাদের ৬১ জন এমএলএর মধ্যে মাত্র একজন মুসলমান। আসামে বাংলাদেশ–বিরোধিতাতেই যে ক্ষমতা মেলে, বিজেপির সফলতা তার প্রমাণ।

কংগ্রেস ২০০১ থেকে ১৬ বছর আসাম শাসন করেছে। মুসলমানরা একচেটিয়াভাবে তাদের সমর্থক ছিল। কিন্তু বোড়োসহ বিভিন্ন জনজাতির আক্রমণ থেকে কংগ্রেস তাদের রক্ষা করছে না দেখে ২০০৫-এ বদরুদ্দীন উমর আজমলের নেতৃত্বে মুসলমানপ্রধান ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) গড়ে ওঠে। স্থানীয় রাজনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি এখন। আসামে ৩৪টি জেলার মধ্যে অন্তত ৯টিতে মুসলমানরা গরিষ্ঠ। রাজ্যের ১৪টি লোকসভা আসনের ৬টিতে তারা জয়-পরাজয়ের নিয়ামক। আরও ৪টিতে তাদের বড় হিস্যা আছে। বরাক ভ্যালি ও লোয়ার আসামে ইউডিএফ নতুন শক্তি হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র আকারে হলেও আসামের রাজনীতিতে মুসলমানদের উত্থানে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ে উদ্বিগ্ন। শঙ্কিত সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনও। বর্তমান সেনাপ্রধান বিপিন রাউত গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে এক আলোচনা সভায় আসামের অনেকগুলো জেলায় মুসলমানদের বৃদ্ধি এবং ইউডিএফের নির্বাচনী সফলতায় উদ্বেগের কথা জানান। ‘বাংলাদেশি’দের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে চীন ও পাকিস্তানের ‘ছদ্ম যুদ্ধ’ কাজ করছে বলেও দাবি তাঁর।

গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিদের এভাবে বারবার বাংলাদেশবিরোধী ভীতি থেকে কার্যত লাভবান বিজেপি। এখন থেকে দুই-তিন মাস পরে অনুষ্ঠেয় নতুন লোকসভা নির্বাচনেও আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে পুরোনো রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে ‘বাংলাদেশি’ অভিবাসীদের ‘গল্প’গুলোই প্রধান ইস্যু হবে। কিন্তু বাংলাদেশ কি আদৌ তাতে বিব্রত?

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক