পুলিশ সদস্যদের অপরাধপ্রবণতা

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) পৃথক তদন্তে ধর্ষণের শিকার এক নারীর সঙ্গে সীতাকুণ্ড থানার পুলিশের কয়েকজন সদস্যের যে আচরণের তথ্য উন্মোচিত হয়েছে, তা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। অপরাধের শিকার অসহায় মানুষ যাঁদের কাছে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে, তাঁরাই যদি তাদের বাড়তি বিপদ ডেকে আনেন, তাহলে ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী মানুষের সমস্ত আশা-ভরসা শেষ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের হালিশহরের এক নারীর ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে।

সম্পত্তিবিষয়ক বিবাদের শিকার ওই নারীকে ধর্ষণ করার পর অপহরণ করা হয়, তারপর তাঁকে ইয়াবা–মাদকসহ গ্রেপ্তার করে থানায় নেয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে খোদ সীতাকুণ্ড থানার পুলিশ। পিবিআই ও ডিবির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাটি সাজিয়েছেন সীতাকুণ্ড থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান, উপপরিদর্শক (এসআই) সিরাজ মিয়া, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জাকির হোসেন এবং ওই নারীর স্বামীর প্রথম স্ত্রী, বর্তমান স্বামীর মৃত প্রথম স্ত্রীর ছেলেসহ কয়েকজন আত্মীয় ও তাঁদের সহযোগী। নারীটি ধর্ষণের শিকার হলেন, অপহৃত হলেন। যেখানে পুলিশের দায়িত্ব তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং ধর্ষণকারীদের গ্রেপ্তার করা, সেখানে তাঁরা তাঁকে অচেতন অবস্থায় গ্রেপ্তার করে তাঁর কোমরে ইয়াবা বড়ি গুঁজে দিয়ে থানায় নিয়ে গেলেন এবং পরদিন তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য বহনের মিথ্যা অভিযোগে মামলা করলেন!

পুলিশ সদস্যদের একটা অংশের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা বা বহনের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার করা এবং এ রকম মামলার ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা আদায় করার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ধর্ষণের শিকার একজন নারীও অচেতন অবস্থায় এমন গর্হিত অন্যায়ের শিকার হতে পারেন—এটা কল্পনাতীত নির্মমতা। আমাদের পুলিশ বিভাগের কোনো কোনো সদস্যের নৈতিক অধঃপতন ও অপরাধপ্রবণতা যে এমন ভয়ংকর মাত্রা অর্জন করেছে, তা দেখে গভীর উদ্বেগ জাগে। কিন্তু সীতাকুণ্ডের ওই তিন পুলিশ সদস্যের এই গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভাগ নিজের দায়িত্ববোধ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পিবিআই ও চট্টগ্রামের ডিবি পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করেছে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ সদস্যদের এসব অন্যায়-অপরাধের তথ্য বেরিয়ে আসার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, শুধু তাঁদের কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করা হয়েছে। আর যাঁরা ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন, অপহরণ করেছেন এবং মাদক মামলায় জড়ানোর কাজে পুলিশকে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদেরও কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আদালতে। কিন্তু একজন নিরীহ সাধারণ মানুষ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করে ন্যায়বিচার পেয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত এই দেশে অত্যন্ত বিরল।

আমরা মনে করি, পুলিশের ওই তিন সদস্য এমন গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, যার আইনি প্রতিকারের দায়িত্ব পুলিশেরই নেওয়া উচিত। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এ ধরনের গুরুতর অপরাধপ্রবণতা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও আইন প্রয়োগের ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা পুলিশ বিভাগের জন্য ব্যাধির মতো একটা বিষয়, যার ফলে এই প্রতিষ্ঠানের জনমুখিতা ও সেবাধর্মিতা গুরুতরভাবে হ্রাস পেতে পারে। এভাবে পুলিশ বিভাগের ওপর জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাস আরও কমে যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষতিকর উপাদান থেকে পুলিশ বিভাগকে মুক্ত করার জন্য শক্তিশালী জবাবদিহির ব্যবস্থা প্রয়োজন। পুলিশ বিভাগের সদস্যদের অপরাধপ্রবণতা রোধ করার জন্য পুলিশের নিজস্ব বিভাগীয় ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় বলে প্রতীয়মান হয়। এ জন্য পুলিশ কমপ্লেইন্টস কমিশনের মতো একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত।