কারা সাংসদ হলেন?

গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ অনুষ্ঠিত হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে অনেক গুরুতর অভিযোগ থাকলেও বাস্তবতা হলো যে এর মাধ্যমে একটি নতুন জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং কোনোরূপ বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে যা আগামী পাঁচ বছর বহাল থাকবে। এমনি বাস্তবতায় কারা নতুন সাংসদ হলেন, তা জানা গুরুত্বপূর্ণ।

অনেকেরই জানা আছে যে উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে তাঁদের শিক্ষা, পেশা, মামলা, আয়, নিজের এবং নির্ভরশীলদের সম্পদ ও দায়-দেনার তথ্য জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। এই রায় প্রাপ্তি ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘সুজন’-এর ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা ছিল। এসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা আমাদের নতুন ২৯৯ জন সাংসদের—যাঁদের মধ্যে ২৬৭ জন নৌকা প্রতীক নিয়ে মহাজোট থেকে, ২২ জন লাঙ্গল নিয়ে জাতীয় পার্টি থেকে এবং ৮ জন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে সাংসদ হয়েছেন—ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে পারি।

প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় যে আমাদের মাননীয় সাংসদদের গড় বয়স ৬০ বছর (৯ জনের বয়স সংগ্রহ করা যায়নি)। নতুন সাংসদদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হলেন নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিল, যাঁর বয়স ২৮ বছর। আর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যাঁর বয়স ৮৮। মহাজোটের সাংসদদের গড় বয়স ৬০, জাতীয় পার্টির ৬১ এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৬২।

নতুন ২৯৯ জন সাংসদের ৮০ দশমিক ৯৩ শতাংশের (২৪২ জন) শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। মহাজোটের সাংসদের মধ্যে এ হার ৮১ দশমিক ৯৪ শতাংশ (২৩৬ জন) এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাংসদদের ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ (পাঁচজন)। নতুন সাংসদদের মধ্যে স্বল্পশিক্ষিত—এসএসসি ও তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন—প্রার্থীর হার ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ (২০ জন)। মহাজোটের সাংসদদের মধ্যে এ হার ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ (১৭ জন) এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ (একজন)।

সব প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর), তবে নতুন সাংসদদের ৮০ দশমিক ৯৩ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত। অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ২২ দশমিক ৮৫ শতাংশ স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসি ও তার চেয়ে কম) হলেও নতুন সাংসদের মাত্র ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ স্বল্পশিক্ষিত। অর্থাৎ প্রার্থিতার তুলনায় উচ্চশিক্ষিতরা যেমন অধিক হারে সাংসদ হয়েছেন, তেমনি স্বল্পশিক্ষিতরা অধিক হারে বাদ পড়েছেন। প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদে উচ্চশিক্ষিতের (স্নাতক বা স্নাতকোত্তর) হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, একাদশ জাতীয় সংসদে যা সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে (৮০ দশমিক ৯৩ শতাংশ)।

নতুন সাংসদদের মধ্যে অধিকাংশের পেশাই (৬১ দশমিক ২০ শতাংশ বা ১৮৩ জন) ব্যবসা। মহাজোটের সাংসদদের এই হার ৬০ দশমিক ৭৬ শতাংশ (১৭৫ জন) এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ (৫ জন)। পক্ষান্তরে নতুনদের মধ্যে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ১৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ (৩৯ জন)। উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীর হার ছিল ৫৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ (১৬৩ জন) ; একাদশ জাতীয় সংসদে তা ৬১ দশমিক ২০ শতাংশ, যা ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি, যদিও এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, এসব ব্যবসায়ীর কারও কারও সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে, যার ফলে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁরা অযোগ্য, কিন্তু মনোনয়নপত্র বাছাই পর্বে তাঁরা বাদ পড়েননি।

নতুন সাংসদদের ২১ জনের (৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে এবং অতীতে মামলা ছিল ১২৩ জনের (৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ) বিরুদ্ধে। অতীত ও বর্তমানে উভয় সময়ে মামলা ছিল বা রয়েছে, এমন সাংসদের সংখ্যা ১৬ জন (৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ), যাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে হত্যার মামলাও রয়েছে। লক্ষণীয় যে মহাজোটের সাংসদদের মধ্যে বর্তমান মামলার হার অতীতে মামলার তুলনায় অনেক কম। পক্ষান্তরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাংসদদের মধ্যে বর্তমান ও অতীত মামলার হার দুটিই বেশি।

নতুন সাংসদদের মধ্যে বাৎসরিক পাঁচ লাখ টাকা বা তার চেয়ে কম আয় করেন মাত্র ২০ জন (৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ) প্রার্থী। প্রসঙ্গত, বছরে কোটি টাকা আয়কারী সাংসদের সংখ্যা ৮০ জন (২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ)। একাদশ সংসদ নির্বাচনে পাঁচ লাখ টাকার কম আয়কারী ৫১ দশমিক ৬৩ শতাংশ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাংসদ হয়েছেন মাত্র ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অপরদিকে বছরে কোটি টাকার অধিক আয়কারী ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাংসদ হয়েছেন ২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। লক্ষণীয়, স্বল্প আয়ের প্রার্থীদের সাংসদ হওয়ার হার প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় অনেক কম, অন্যদিকে অধিক আয়কারীদের সাংসদ হওয়ার হার প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় অনেক বেশি।

নতুন সাংসদদের মধ্যে ২৪৬ জনের (৮২ দশমিক ৫৫ শতাংশ) সম্পদ কোটি টাকার ওপরে। উল্লেখ্য, ২৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ কোটিপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাংসদ হয়েছেন ৮২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে ২৫ লাখ টাকার কম সম্পদের মালিক ৫৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাংসদ হয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে অধিক সম্পদের মালিকদের সাংসদ হওয়ার হার বেশি। প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদে কোটিপতির হার ছিল ৭১ দশমিক ৩৩ শতাংশ (২১৪ জন) আর একাদশ জাতীয় সংসদে এই হার ৮২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

উল্লেখ্য, হলফনামায় যে তথ্য দেওয়া হয়, তাতে সম্পদের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না, কারণ সম্পদের পরিমাণ সাধারণত বাজারমূল্যের পরিবর্তে অর্জিত মূল্যে প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়া অনেকে সম্পদের মূল্যই উল্লেখ করেন না। তাই সাংসদদের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ হলফনামায় যা দেখানো হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া তথ্য গোপনের সমস্যা তো রয়েছেই। প্রসঙ্গত, এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমরা অনেক দিন থেকেই নির্বাচন কমিশনের কাছে হলফনামার ছকটি পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।

নতুন সাংসদদের মধ্যে আয়কর প্রদানকারীর হার ৬৩ দশমিক ২১ শতাংশ (১৮৯ জন)। এঁদের মধ্যে লক্ষাধিক টাকার অধিক আয়কর প্রদানকারী সাংসদের সংখ্যা ১৫০ জন (৭৯ দশমিক ৩৬ দশমিক)। উল্লেখ্য, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিলেন আয়কর প্রদানকারী। তাঁদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ৬৩ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্থাৎ আয়কর প্রদানকারীরা অধিক হারে সাংসদ হয়েছেন। তবে দশম সংসদে করদাতার হার ছিল ৮৬ শতাংশ (২৫৮ জন), আর একাদশ জাতীয় সংসদে এই হার ৬৩ দশমিক ২১ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী সংসদের তুলনায় ২২ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম।

সার্বিকভাবে বলতে গেলে, এবারের নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত অধিক শিক্ষিতরা নির্বাচিত হয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক হলো, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় বেশি হারে সাংসদ হয়েছেন, যাঁদের পেশা ব্যবসা। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে ব্যবসায়ীদের সাংসদ হওয়ায় দোষের কিছু নেই, তবে অধিকাংশ সাংসদই ব্যবসায়ী হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়—কারণ সংসদে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়। আরেকটি নেতিবাচক বিষয় হলো, আগের তুলনায় এবারের নতুন সাংসদদের মধ্যে আয়কর প্রদানকারীর হার কম। প্রসঙ্গত, হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে, তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা, যার মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনী অঙ্গনকে বহুলাংশে কলুষমুক্ত করা সম্ভব হবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক