বাংলাদেশে ক্যানসার ও আমাদের করণীয়

প্রাণঘাতী ক্যানসার দুনিয়াজুড়েই উদ্বেগ ও আতঙ্কের বিষয়। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। একই সময় ক্যানসারে মৃত্যুর সংখ্যা ৯৬ লাখ। বিশ্বে মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ ক্যানসার এবং মোট মৃত্যুর ১৬ শতাংশ ক্যানসারজনিত। বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ ক্যানসারে মৃত্যু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। বাংলাদেশের অবস্থাও উদ্বেগজনক।

২০১২ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যানসার রোগী আছে। প্রতিবছর দুই লাখ করে নতুন ক্যানসার রোগী ধরা পড়ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশ ক্যানসারজনিত। বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ফুসফুসের ক্যানসার। এ ছাড়া গলা, মুখগহ্বর ও কলোরেক্টাল ক্যানসারে আক্রান্ত হয় পুরুষ। মেয়েদের সবচেয়ে বেশি হয় স্তন, সার্ভিক্স ও ফুসফুস ক্যানসার।

ক্যানসার কি নিরাময়যোগ্য? যদি শুরুতেই ধরা পড়ে, তাহলে কোনো কোনো ক্যানসার নিরাময়যোগ্য। দুর্ভাগ্যক্রমে বেশির ভাগ ক্যানসারের ক্ষেত্রে শুরুতে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অন্য কোনো অসুখে সার্জারি করার সময় হঠাৎ করেই প্রারম্ভিক ক্যানসার ধরা পড়ে। কোনো কোনো ক্যানসার, যেমন: স্তন, সার্ভিক্স, অণ্ডকোষ ও প্রোস্টেট ক্যানসার স্ক্রিনিং টেস্টের সময় প্রারম্ভিক অবস্থায় ধরা পড়ে।

যা–ই হোক, কিছুটা পরে হলেও ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা গেলে তা উপেক্ষা করা ঠিক নয়। বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য শেষ পর্যায়ে আসে। তখন নিরাময় দূরের কথা, চিকিত্সাই প্রায় দুরূহ হয়ে পড়ে।

ক্যানসার চিকিৎসা
ক্যানসার চিকিৎসার প্রধান তিনটি পদ্ধতি—সার্জারি, রেডিয়েশন–থেরাপি ও কেমোথেরাপি। যদি প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসারের টিউমার ধরা পড়ে, তাহলে শুধু সার্জারি প্রয়োগ করলেই চলে। যদি টিউমার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সার্জারির পর রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়, যার দ্বারা সার্জারির পরও থেকে যাওয়া ক্যানসার সেলগুলো মেরে ফেলা যায়। যেসব ক্ষেত্রে সার্জারি করা সম্ভব হয় না, সেসব ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি একাকী অথবা যুগপৎ প্রয়োগ করা হয়।

কখনো আবার রেডিওথেরাপি/কেমোথেরাপি প্রয়োগ করে টিউমারকে সংকুচিত করে সার্জারি প্রয়োগ করা হয়। যদি ক্যানসার তার আদি অবস্থান থেকে দেহের দূরবর্তী অংশে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সাধারণত কেমোথেরাপি একমাত্র অবলম্বন।

ক্যানসার চিকিৎসা দুই ধরনের হয়—একটি ক্যানসার থেকে আরোগ্য লাভের জন্য, অন্যটি ক্যানসারের ব্যথা ও যন্ত্রণা লাঘব করা এবং আয়ু যত দূর সম্ভব দীর্ঘায়িত করার জন্য।

রেডিয়েশন–থেরাপি
বিশ্বের সব ক্যানসার রোগীর মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ সম্পূর্ণ নিরাময় লাভ করে। এর মধ্যে ২২ শতাংশ সার্জারি (এককভাবে অথবা প্রধান পদ্ধতি হিসেবে), ১৮ শতাংশ রেডিয়েশন–থেরাপি (এককভাবে অথবা প্রধান পদ্ধতি হিসেবে) এবং ৫ শতাংশ কেমোথেরাপি (এককভাবে বা প্রায়ই সার্জারি/রেডিওথেরাপি সহযোগে)। ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ রেডিওথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা পেয়ে থাকে, যার মধ্যে আছে প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা, অসুখ ফিরে আসার পর চিকিৎসা অথবা ব্যথা লাঘবের জন্য চিকিৎসা। রেডিয়েশন দিয়ে ক্যানসার সেলের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় এবং সেলের প্রজননক্ষমতা বিনষ্ট হয়। যখন ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ–সংবলিত সেল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তখন সেগুলো প্রাকৃতিকভাবে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। সুস্থ সেলও রেডিয়েশন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তবে তারা নিজেরা নিজেদের সারিয়ে তুলতে পারে। এ ছাড়া রেডিয়েশন–থেরাপির মূল উদ্দেশ্য থাকে টিউমার যেন সর্বোচ্চ ডোজ পায় এবং সুস্থ টিস্যু ও গুরুত্বপূর্ণ অর্গান যেন সর্বনিম্ন ডোজ পায়। সাধারণত রেডিয়েশেন চিকিৎসায় সমস্ত ডোজকে ২৫ থেকে ৩৫ দিনে অল্প অল্প করে প্রয়োগ করতে হয়।

বিভিন্ন ধরনের রেডিওথেরাপির মধ্যে বাইরে থেকে প্রদত্ত রশ্মিই সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। এ কাজের জন্য Linear Accelerator (Linac) মেশিন থেকে উৎপন্ন অতি উচ্চ শক্তির এক্স-রে অথবা ইলেকট্রন রশ্মি ব্যবহৃত হয়। অতি উচ্চমূল্যের এই মেশিনে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কম্পিউটার সফটওয়্যারের এক বিস্ময়কর প্রয়োগ। যন্ত্রটি ক্যানসার টিউমারে সর্বোচ্চ ডোজ এবং একই সঙ্গে তার চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ অর্গান বা সুস্থ টিস্যুতে সর্বনিম্ন ডোজ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন ডোজের পরিমাণ ও কোন কোন দিক থেকে তা প্রয়োগ করতে হবে, তা করা যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সঠিকভাবে। বিভিন্ন দিক থেকে যে রশ্মি ফেলা হয়, তার আকার সেই দিক থেকে দেখতে পাওয়া টিউমারের আকারের সঙ্গে ম্যাচ করে সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। এই যন্ত্রপাতি যেমন জটিল, পদ্ধতিও জটিল এবং সামগ্রিকভাবে নিয়মিত বিভিন্ন রকম টেস্ট ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন হয়, যা শুধু মেডিকেল ফিজিসিস্ট দ্বারা যথাযথভাবে করা সম্ভব হয়। উন্নত বিশ্বে রেডিয়েশন–থেরাপি সেন্টারগুলোয় ভালো মেডিকেল ফিজিসিস্ট রাখার ওপর সমধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে রেডিয়েশন–থেরাপি
বাংলাদেশে আদর্শভাবে ৩০০টি লিন্যাক মেশিন থাকার কথা, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় আছে মাত্র ১৩টি। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোয় আছে আটটি মেশিন, যা হয় অকেজোভাবে পড়ে আছে অথবা সেই মেশিনে আধুনিক পদ্ধতিতে নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা করা হয় না। দরিদ্র রোগীরা খুব কমই পারে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে উচ্চমূল্যে রেডিওথেরাপি নিতে। আর সরকারি হাসপাতালে আধুনিক পদ্ধতিতে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় না। যা দেওয়া হয়, তাও পেতে রোগীর ভিড়ে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়, তত দিন রোগীর অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। মেডিকেল ফিজিসিস্ট ছাড়া রেডিওথেরাপি সেন্টারগুলো যথাযথভাবে স্থাপন ও মানসম্পন্নভাবে পরিচালনা সম্ভব নয়। এ কারণে সরকারি হাসপাতালে দরিদ্র রোগীরা আধুনিক রেডিয়েশন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়।

ক্যানসার প্রতিরোধ
ক্যানসার হওয়ার জন্য দায়ী লাইফস্টাইল, পরিবেশ আর পারিবারিক ইতিহাস। ঝুঁকির কারণগুলো হলো ধূমপান, প্যাসিভ ধূমপান, সুপারি চিবানো, বেশি চর্বিযুক্ত খাবার, স্বল্প ফল ও সবজি আহার, ব্যায়াম না করা, ইউভি-রশ্মি, দৈহিক স্থূলতা, বায়ুদূষণ, শিল্পদূষণ, বিশেষ কতকগুলো রাসায়নিক পদার্থ ও জিনগত ঝুঁকি। যেসব কারণে ক্যানসার হয়, সেগুলো এড়িয়ে চলা এবং যা করলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কমে, সেগুলো করা উচিত। ক্যানসার প্রতিরোধের উপায়: ১. ধূমপান বা নিষ্ক্রিয় ধূমপান না করা, ২. পানে সুপারি না খাওয়া, ৩. ক্যানসারজনক পদার্থ (carcinogen) এড়িয়ে চলা, ৪. দৈহিকভাবে সক্রিয় থাকা এবং স্থূলতা পরিহার করা, ৫. নিয়মিত হাঁটা অথবা অন্য কোনো ব্যায়াম করা, ৬. অনধিক ক্যালরি, লবণ ও চর্বি আছে এমন স্বাস্থ্যপ্রদ খাবার খাওয়া, ৭. বেশি সবজি ও ফল খাওয়া, ৮. গরু, ছাগল, ভেড়ার মাংস কম খাওয়া, ৯. মদ্যপান না করা, ১০. জিনগত ঝুঁকি থাকলে সতর্কতার জন্য ক্যানসার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কী করা যায়? ক্যানসার রোগীদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সীমাহীন। পাশাপাশি রোগীর পরিবারের মানসিক ব্যথা ও দুশ্চিন্তা অকল্পনীয়। ক্যানসার চিকিৎসা অধিকাংশ সময় দীর্ঘমেয়াদি এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর ফলে রোগী ও তার পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ে এবং তাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। এ ছাড়া অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী যথাযথ চিকিত্সাই গ্রহণ করতে পারে না। সরকারের উচিত সব বিভাগীয় শহরে ক্যানসার কেয়ার সেন্টার তৈরি করা, যেখানে রেডিয়েশন–থেরাপিসহ সামগ্রিক ক্যানসার চিকিৎসার আধুনিক সুবিধাদি ও উপযুক্ত জনবল থাকবে। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উদ্যোগে সাভারে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিকেল ফিজিকস স্থাপন করা হয়েছে। এর কার্যক্রমের ক্রমবর্ধমান ব্যাপ্তি ঘটছে এবং দেশের অন্য অঞ্চলে এর শাখা খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় যথাযথ রেডিওথেরাপি সেন্টার তৈরিতে এবং অপরিহার্য লোকবল সৃষ্টিতে এই প্রকল্প সফল নেতৃত্ব দিতে পারবে বলে মনে হয়।

প্রতিটি মেডিকেল কলেজে সাধারণ চিকিৎসকদের ক্যানসার সতর্কীকরণ ও প্রারম্ভিক অবস্থায় ক্যানসার চিহ্নিত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। সরকার ও এনজিওগুলোর উচিত কতকগুলো ক্যানসার, যেমন: স্তন, সার্ভিক্স ও মুখগহ্বর ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় ধরার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সাধারণ জনগণের ভেতর ক্যানসারের ঝুঁকি ও ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এনজিওগুলো ব্যাপক পদক্ষেপ নিতে পারে। ক্যানসারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ধূমপান রোধকল্পে ব্যাপকতর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন। রাষ্ট্র ও সমাজকে ভবিষ্যতে ক্যানসারের ব্যাপ্তি রোধকল্পে এখনই সব সম্ভাব্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: ড. এম আমিনুল ইসলাম, সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল ফিজিকস অ্যাসোসিয়েশন; সাবেক উপাচার্য, শাবিপ্রবি, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, রাবি; [email protected]