ছাত্র সংসদের যে ঐতিহ্য বাদ দেওয়া দরকার

ঘুম, খাওয়া বা শৌচের জায়গা মানুষের ‘প্রাইভেট স্পেস’ বা ব্যক্তি–অধিকারের অঞ্চল, বাইরের সবকিছু থেকে আড়ালে রাখার অঞ্চল। আর নির্বাচন, রাজনীতি বা সংগঠন ‘পাবলিক অ্যাফেয়ার্স’ বা বাইরের কায়-কারবার যা ‘প্রাইভেট স্ফিয়ার’, মানে ‘ঘরে’র বাইরেই থাকা উচিত।

কাজেই শুধু ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ভোট বাক্সই না, আমাদের পুরা ছাত্ররাজনীতিটাই ছাত্রাবাসের বাইরে নিয়ে আসা দরকার। হল সংসদসহ সব ছাত্রসংগঠনের হলকেন্দ্রিক কার্যকলাপ বা ‘হল কমিটি’ বিলুপ্ত হওয়া দরকার। ছাত্ররাজনীতির সুস্বাস্থ্যের স্বার্থেই এটা করা দরকার। কারণ, ৩০ বছর ধরে ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রদের ‘ঘুম-খাওয়া-শৌচ’ অধিকারকে জিম্মি করে টিকে আছে মূলত একটা মাস্তানতন্ত্র। এর মূল কাজ ক্ষমতাসীন দলের দরকার মতন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণের কাজ করা, আর একই কাজে সরকার নিয়োজিত প্রশাসনকে সহায়তা করা।

এ কারণে ছাত্ররাজনীতি বলে আসলে আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। শুধু শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বা দলীয় মতাদর্শ প্রচারের জন্য পরিচালিত কিছু সন্ত্রাস বা সাংগঠনিক কার্যকলাপকে ছাত্ররাজনীতি ধরে নিয়ে দুশ্চিন্তামূলক কথাবার্তা আর লেখালেখি চলছে তিন দশক ধরে। সমাজবিদ্যা এক চর্চার জায়গা হলেও সেসব বিদ্যা কখনো শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি। বরং দেখা গেছে, বিদ্যুৎ-বিদ্যার অধ্যাপকও নিজের মতাদর্শগত মাথাটা ব্যাপক ঘামিয়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তামূলক লেখালেখি করছেন।

জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ বদলাতে হলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে বোনা বীজগুলোও বদলানো দরকার। কিছু নিড়ানিও দরকার। সে জন্য প্রথম পূর্বশর্ত হচ্ছে ছাত্রাবাসগুলো থেকে রাজনীতি বিদায় করে ব্যক্তি–মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আর মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া। তাহলেই কেবল দেশের ক্ষমতাতন্ত্রের এই ভবিষ্যৎ চালকেরা সাধারণের অধিকার আর মর্যাদা রক্ষা করে কাজ করতে শিখবেন। কাজেই ছাত্ররাজনীতিকে বিকশিত হওয়ার জন্য নতুন জমিন দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।

প্রায় ভুলে যাওয়া প্রথাসিদ্ধ ‘হল ছাত্র সংসদে’র বদলে ছাত্রাবাসগুলোর সামাজিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি কক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি নিয়ে ছাত্রদের একটা ব্যবস্থাপনা পরিষদ থাকতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক হলে ছাত্রদের নিজেদের ব্যবস্থাপনায় যেভাবে খাওয়ার ‘মেস’ চলে, অনেকটা সে রকম। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই খাওয়ার ক্ষেত্রে এমন সুচারু বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে পারলে অন্য সমস্যাগুলোর সমাধানেও আরও অনেক কিছুই করতে পারবেন নিশ্চিত। শুধু রাজনৈতিক মাস্তানতন্ত্রের হাত থেকে হলগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারলেই হবে। এই ব্যবস্থাপনা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হল প্রশাসন ও প্রভোস্ট কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে একটা অংশীদারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য, দলাদলিজাত স্বার্থের সংঘাত বা সন্ধির সংক্রমণ থেকে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

প্রতিটি বিভাগের প্রতিটি ব্যাচের দুই বা চারজন সমান নারী-পুরুষ শিক্ষার্থী নিয়ে বিভাগের ছাত্র সমিতি হওয়া দরকার। ছাত্র সমিতির প্রতিনিধিদের একাডেমিক কমিটি ও ফ্যাকাল্টির সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা দরকার। সঙ্গে ফ্যাকাল্টির পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিকেও। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ‘গ্রিভেন্স’ বা সংক্ষোভের প্রতিকার, পাঠদানের প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা আর পরীক্ষাপদ্ধতির ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার স্বার্থেই এইটা জরুরি। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক ও সামাজিক প্রযত্নেও ভূমিকা রেখে এই অংশীদারত্ব সামগ্রিক শিক্ষাপ্রক্রিয়াকেই অনেক স্বাস্থ্যকর করে তুলতে পারে।

রুম ও ব্যাচ পর্যায়ের সব প্রতিনিধিত্বের মেয়াদ হওয়া উচিত সর্বোচ্চ তিন মাস, যা পালাক্রমে সব শিক্ষার্থীকেই পালন করতে হবে। হল ও বিভাগ পর্যায়ে সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ছয় মাস। আর এটাই হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সামাজিক কর্তব্য আর দায়িত্ববোধ বিকাশের বনিয়াদ। ব্যক্তি আর যৌথের যোগসূত্র বুঝে নেওয়ার জায়গা, মানে আমরা যাকে ‘লিডারশিপ স্কিল’ বা নেতৃত্বের গুণাবলি বলি, তার বিকাশের ক্ষেত্র। শিক্ষার্থীদের এসব অর্জন করতে পারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণপ্রক্রিয়ারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারিকুলামের ভাষায় যাকে ‘গ্র্যাজুয়েট প্রোফাইল’ বা ‘স্নাতকের কাঙ্ক্ষিত গুণাবলি’ বলা হয়। শিক্ষার্থীরা এসব অর্জন করতে না পারলে শিক্ষাপদ্ধতি বা বিশ্ববিদ্যালয়ই ফেল করে, ছাত্ররা না।

আর হল ও বিভাগ পর্যায়ের এই প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করতে হবে ছাত্র সংসদের সাধারণ পরিষদ, এক বছর মেয়াদে নির্বাচিত একটা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ যার কাছে নিয়মিত জবাবদিহির জন্য বাধা থাকবে। সাধারণ পরিষদ অনাস্থা জানালে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের যেকোনো সদস্য বা পুরো সংসদকেই পদত্যাগ করতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট পর্যায়ের সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ায় এই কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ প্রতিনিধিদের যুক্ত করতে হবে।

কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচনে ছাত্রসংগঠন যেমন প্যানেল দিতে পারবে, নিঃসংঘ শিক্ষার্থীরা তেমনি স্বতন্ত্র দাঁড়াতে পারবেন। ভোট হতে হবে টিএসসি বা ছাত্র সংসদ কেন্দ্রের মতো কোনো জায়গায়, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান মাস্তানতন্ত্রের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে। সঙ্গে নিয়ম করতে হবে যে শুধু নিয়মিত অনার্স আর মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষার্থীরাই প্রার্থী হতে পারবেন, নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় যাঁদের ডিগ্রি শেষ করার জন্য বাড়তি এক বছর সময় দেবে। বাণিজ্যিক বা পেশাদার কোর্সের শিক্ষার্থীদের বিভাগ পর্যায়ের প্রতিনিধিত্বসহ সাধারণ পরিষদে যুক্ত করতে হবে; কিন্তু কেন্দ্রীয় সংসদে না। স্নাতকোত্তর গবেষণা ডিগ্রির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও তা–ই করতে হবে, যাতে শুধু ছাত্র সংসদের নেতা হওয়ার জন্য ‘ছাত্র সাজা’র পথগুলো বন্ধ হয়।

প্রায় ৩০ বছর বিরতির পরে এসে ৩০ বছর আগের কায়দায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা মানে ৩০ বছর ধরে দেশে চলতে থাকা সংসদীয় রাজনীতির একটা ক্যাম্পাস সংস্করণ তৈরি করা। ক্যাম্পাসগুলোয় সেটা তো মোটামুটি ৩০ বছর ধরে কায়েম হয়েই আছে। সেটা আরও জোরদার করার জন্য নির্বাচন যে খুব জরুরি কিছু না, তা দেশে ১২ বছরে তো দেখাই গেল। কাজেই নির্বাচনী গণতন্ত্রের বিশ্ববিদ্যালয় সংস্করণ না দেখলেও চলবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদকে ‘মিনি পার্লামেন্ট’ ভাবাটা আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পেটে ফাঁপানো ঐতিহ্যবোধ আর শ্লাঘার কারণে তৈরি হওয়া বোকামির ঢেকুর। ‘ঐতিহ্য’ পুনরুদ্ধার বা রক্ষার নামে ঐতিহ্যিক কায়দায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে দেশে বিদ্যমান পার্লামেন্টারি পরিস্থিতিটাকে ক্যাম্পাসে আরও পোক্ত করার কোনো মানে নেই। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কখনোই জাতীয় রাজনীতিকে অনুসরণ বা তার ‘মিনি সংস্করণ’ হয়ে ওঠার কথা ছিল না; বরং জাতীয় রাজনীতিরই নিজ উৎকর্ষ সাধনের প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করার কথা, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের মানে টেনে না নামিয়ে সেখানে স্বায়ত্তশাসনের মুক্ত আবহে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মান অর্জনের চেষ্টা করার কথা।

আর সর্বজনীন বা পাবলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে বিদ্যায়তনিক জ্ঞান বিকাশের পাশাপাশি আমাদের নানাবিধ যৌথ জীবনাচারের নিরীক্ষামূলক চর্চায় নিবিষ্ট থেকে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র-সমাজের জন্য একটা ‘মিনি মডেল’ হতে থাকা, বিকল্প চিন্তা ও চর্চার নিরবচ্ছিন্ন উৎস আর আধার হয়ে থাকা।

বখতিয়ার আহমেদ: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।