সুয়োরানি ও দুয়োরানির গল্প

কাগজে-কলমে রাষ্ট্রভাষা হলেও কাজে-কর্মে বাংলা রাষ্ট্রভাষা নয়। দাপ্তরিক এবং বিচারিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার আগের তুলনায় অবশ্যই বেড়েছে, কিন্তু সরকার ও জনগণের পছন্দের ভাষা বাংলা নয়। একটি অতি সাধারণ পরিবারের বিয়ের দাওয়াতপত্রও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইংরেজিতেই লেখা হয়। বাংলাদেশের শহরগুলোতে দোকানের নাম, কোম্পানির নাম ইংরেজিতে রাখা দস্তুর। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্রিকেট দলের নাম বাংলায় রাখা হয়নি। টেলিটক, বিজিবি, এনসিটিবি ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামও ইংরেজি।

সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক—কোনো ভাষার এই তিন ধরনের প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা যেতে পারে। একটি ভাষা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম লক্ষণ সেই ভাষায় সাহিত্য রচিত হওয়া। মধ্যযুগেই বাংলার সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রে প্রচলিত একাধিক ভাষার মধ্যে বিশেষ একটি ভাষা যদি দাপ্তরিক বা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে সেই ভাষাটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জিত হয়। ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল বাংলা ভাষার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা। ‘বাংলা কি আদৌ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা?’ ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৭০ বছর পরেও এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক।

শিক্ষিত জনগণের একটি বড় অংশ চায় শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হোক। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কোথায় নেই? সরকার নিজেই বাংলা মিডিয়াম স্কুলে চালু করেছে ইংলিশ ভার্সন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যে প্রতিষ্ঠানটি কিনা ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার, সেখানেও অনেক বিভাগে ও ইনস্টিটিউটে ইংরেজিতে পড়ানো হয় এবং পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সংবিধান বা স্ট্যাটিউটটের বাংলা অনুবাদ করতে সক্ষম হয়নি।

বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের পছন্দের ভাষা বাংলা নয়। এক রাজা। তার দুই রানি। সুয়োরানি ও দুয়োরানি। ইংরেজি সুয়োরানি আর বাংলা দুয়োরানি! রূপকথায় কী হয়? সুয়োরানি রাজার সঙ্গে থাকে আর দুয়োরানিকে দুয়ো দিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হয়!

ইংরেজির পক্ষে প্রধান যুক্তিগুলো কী? বলা হয়ে থাকে যে এই ভাষাটি হচ্ছে গোলাকার বিশ্বের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’। এটা ‘লিঙ্গুয়া একাডেমিকা’ও বটে। লেখাপড়ার ভাষা ইংরেজি এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা ইংরেজি। ইংরেজির পক্ষে আরেকটা যুক্তি হচ্ছে ইংরেজি যদি শিক্ষার মাধ্যম হয়, তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক চাকমা, মারমা, গারো, খাসি, ম্রোদের আর কষ্ট করে বাংলা শিখতে হচ্ছে না। বাংলার বিপক্ষে যুক্তিগুলো কী? বাংলা হচ্ছে নেহাতই একটা অনুন্নত আঞ্চলিক ভাষা। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বাংলায় করা যায় না। উচ্চশিক্ষা বাংলা ভাষায় করা যায় না, কারণ এ ভাষায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক নেই। যে যুক্তিগুলো ইংরেজির পক্ষে সেগুলো বাংলার বিপক্ষে, বলাই বাহুল্য।

পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা প্রথমে পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল কেন? কারণ একটাই, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ ‘দুধ-ভাত’ হচ্ছে এখানে অর্থনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি। আমাদের পূর্বসূরিরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন, যাতে করে আমরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হই, যেন আমরা উন্নত চিন্তা করতে পারি। কোন ভাষাটি রাষ্ট্রভাষা হবে, কোন ভাষাটি শিক্ষার মাধ্যম হবে—এই সিদ্ধান্তের ওপরে দেশ ও জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতি শতভাগ নির্ভর করে।

ইংরেজিকে অবলম্বন করে উন্নতি করলে সমস্যা কী? সমস্যাটা মূলত প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। নোয়াম চমস্কি ষাটের দশক থেকে দাবি করে আসছেন, মানবশিশু একটা ভাষা-অঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অঙ্গটির নাম বিশ্ব ব্যাকরণ। এটা এমন একটা ডিভাইস, যা জন্মের পর থেকে ১০ থেকে ১১ বছর বয়সের মধ্যে কোনো না–কোনো ভাষার ইনপুট, অর্থাৎ উচ্চারিত শব্দ ও বাক্য দিয়ে সচল করতে হয়। বাংলাদেশের শিশুরা চাটগাঁইয়া, নোয়াখাইল্যা, সিলেটি, ঢাকাইয়া বাংলার ইনপুট পায়। সুতরাং অনেক চেষ্টা করে কয়েক লাখে হয়তো কয়েকজন লোক পাওয়া যাবে, যারা সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে সক্ষম হবে।

ইংরেজি মাধ্যমের বেশির ভাগ শিশু দ্বিভাষী বা বাইলিঙ্গুয়াল হচ্ছে না। তারা বাংলাও ভালোভাবে শিখছে না, ইংরেজিও ঠিকমতো শিখছে না। ‘সেমিলিঙ্গুয়াল’ বা অর্ধভাষী হয়ে উঠছে তারা একেকজন। ভাষা যদি জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হয়, একজন অর্ধভাষী ব্যক্তি ঠিকমতো জ্ঞানচর্চা করতে পারার কথা নয়। যখনই আপনি ফোন করবেন কোনো ব্যাংকে কিংবা মোবাইল সেবা অফিসে, অদ্ভুত এক একসেন্টে বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে কেউ একজন আপনাকে বলবে, ‘স্যার, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ? কী করে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?’ এই কিম্ভূত উচ্চারণ ও ভাষা ব্যবহার আপনার আমার অপকর্মের ফসল। আপনি শিশুকে ইংলিশ মিডিয়ামে, ইংলিশ ভার্সনে পড়াচ্ছেন। ভাষা শেখার বয়সে শিশু ইংরেজি ধ্বনিতত্ত্ব আয়ত্ত করেছে এবং সেই ধ্বনিতত্ত্ব দিয়ে সে বাংলা বলার চেষ্টা করছে।

ইংরেজির রোগ একাধারে সংক্রামক ও বংশগত। আজ থেকে মাত্র ১০০ বছর আগের একটি ছবি কল্পনা করুন। সার্কিট হাউসের বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে আছেন এক সাহেব, আর আমাদের পিতামহ মেঝেতে বসে সাহেবের পা টিপছেন। সাহেব সোনা-বাঁধানো গড়গড়ার নলে সুখটান দিচ্ছেন আর পান থেকে চুন খসলেই খিস্তি করে উঠছেন: ‘ড্যাম নিগার।’ আমাদের পিতামহ সাহেবের গালাগালিতে কান দিচ্ছেন না। নিচে বসে সাহেবের পা টিপতে টিপতে তিনি স্বপ্ন দেখছেন: সাহেবের আরাম কেদারায় বসে আছে তাঁর ছেলে, পা টেপার জন্য এসেছে নতুন এক খেদমতগার। খেদমতগারটি যদিও বাঙালি, তবু আসনের গুণে ছেলে তাকেও ‘ড্যাম নিগার’ বলছে। পিতামহ তখন আর পা টিপছেন না, কারণ তিনি তো তখন কালা সাহেবের বাপ! বাঙালি মনের অবচেতনে এ স্বপ্ন পুরুষানুক্রমে সজীব আছে বলে এ দেশে ইংলিশ মিডিয়ামের বাজার তৈরি হয়েই আছে। ইংরেজি রোগ সংক্রামক বলেই আশপাশের সবাই এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যেকোনো রোগই সংক্রামক হয়, স্বাস্থ্য নয়।

শিশির ভট্টাচার্য্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক