তরুণদের কর্মসংস্থান = সোনার বাংলা

দেশে অনেক সমস্যা। কিন্তু সব সমস্যা তো একসঙ্গে সমাধান করা যাবে না। যদি এমন কোনো জ্বলন্ত সমস্যা বেছে নিই, যার সমাধান অন্য সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ খুলে দেবে, তাহলে সেদিকে মনোযোগ দিলে অসাধ্য সাধন সম্ভব। এই মুহূর্তে আমরা বলতে পারি তরুণদের কাজের সুযোগ, অর্থাৎ কর্মসংস্থান সবচেয়ে জরুরি। প্রতিবছর এই যে প্রায় ২০ লাখ তরুণ কর্মবাজারে আসেন আর সারা বছর চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ধরনা দেন, তাঁদের যদি উপযুক্ত ও সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এই ২০ লাখ তরুণের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের অন্তত আরও ৬০-৭০ লাখ মানুষের খুশির অন্ত থাকবে না।

বেশ কয়েক বছর আগে আমি ঢাকা ক্লাবের সামনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। একজন তরুণ এসে আমার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। প্রথম আলোর সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে তিনি একটা চাকরির জন্য আমাকে এমনভাবে ধরলেন যে আমি রীতিমতো অসহায় বোধ করতে থাকলাম। কারণ জানি, কারও চাকরির ব্যবস্থা করা আমার সাধ্যে কুলাবে না। পরে বেশ কয়েকবার সেই তরুণ আমাকে ফোন করে হতাশ হয়েছেন। জানি না তিনি চাকরি পেয়েছেন কি না। আমি এখনো দুজন উচ্চশিক্ষিত, ভালো রেজাল্ট, এমন তরুণীর সিভি নিয়ে ঘুরছি। বছরখানেক হতে চলল, চাকরির ব্যবস্থা করতে পরলাম না।

কিন্তু কেন এ অবস্থা? তাঁরা ইন্টারভিউ দেন, তারপর শোনেন, যে ধরনের কর্মী দরকার, সে রকম দক্ষতা নাকি তাঁদের নেই। অথচ নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ডিগ্রি, ভালো রেজাল্ট তাঁদের। সেখানে বিদেশি কর্মী তারা নিয়োগ দেয়।

তার মানে আমাদের তরুণেরা যা শিখছে, সেটা কর্মমুখী নয়। কী করতে হবে? এ বিষয়টি নিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম আলো ও ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি) একটি গোলটেবিল বৈঠক করে। সেখানে কথা বলেন কিছু তরুণ। তাঁরা রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। তরুণদের মনের কথা তাঁরা জানেন, কারণ তরুণদের মধ্যে তাঁরা কাজ করেন। আরও উপস্থিত ছিলেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং কর্মসংস্থানের পরামর্শ দিতে পারেন, এমন ব্যক্তিরা।

তরুণদের একটাই কথা। দক্ষতার অভাবে তাঁরা মরছেন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চলছে। তার মানে এখন ডিজিটাল লাইনে দক্ষতা ছাড়া কোনো কাজ চলে না। এমনকি শুধু কম্পিউটারে কম্পোজ, ই-মেইল, গুগল সার্চ জানাই যথেষ্ট নয়। আগে ভাবতাম একটা কম্পিউটার নিয়ে বসে গেলেই যথেষ্ট। ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে আয় সম্ভব। কিন্তু এখন আর তাতে চলবে না। রোবট এসে গেছে। নতুন নতুন সফটওয়্যারে কাজ চলে। এখন জানতে হবে কম্পিউটারে জটিল সফটওয়্যার চালিয়ে কাজ করার দক্ষতা, গ্রাফিকস, বিভিন্ন সফটওয়্যার কাস্টমাইজ করতে পারা ইত্যাদি। এই হলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা। আমাদের অনার্স-মাস্টার্সের সিলেবাসে না থাকলেও এসব শিখে নিতে হবে।

সেদিনের আলোচনায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি ও পরিচালক আবুল কাশেম এই কথাটিই সুন্দরভাবে বললেন। তাঁর ভাষায় তরুণদের গ্লোবাল সিটিজেন অর্থাৎ বিশ্ব-নাগরিক হতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়াই যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে থাকতে হবে ‘কমিউনিকেশনস স্কিল’ বা মতবিনিময়ের দক্ষতা। বিদেশিদের সঙ্গে ইংরেজি বা ক্ষেত্রবিশেষে অন্য কোনো ভাষা, যেমন চীনা বা জাপানি ভাষায় কথা বলতে না পারলে আজকের বিশ্বে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা কঠিন। যেকোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান চাইবে তার কর্মীরা বাংলা, ইংরেজি এবং অন্তত আর একটি বিদেশি ভাষায় যেন দক্ষ হয়। তাহলে তাদের আর সমস্যা নেই।

কাশেম সাহেব তো এমনও বললেন যে কোনো তরুণের যদি এই দক্ষতাগুলো থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিয়োগ দেবেন। তার ডিগ্রি অনার্স না মাস্টার্স, জিপিএ-৫ না কী, সেটা তখন বড় কোনো ব্যাপার না।

মাতৃভাষা বাংলায় তো অবশ্যই দক্ষ হতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতি হবে আমাদের মূল ভিত্তি। কারণ, মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি ছাড়া আমাদের উচ্চতর জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। এরপর ইংরেজি ও অন্য আরও একটি ভাষা এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে।

মনে পড়ল প্রায় দেড় যুগ আগের একটি ঘটনা। ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে বিলাতে গেছি। তাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মী আমাদের গ্রুপের সঙ্গে কাজ করছিলেন। তিনি একদিন জিজ্ঞেস করলেন, আমার লেখাপড়া কত দূর। বললাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স-মাস্টার্স। তিনি অবাক হয়ে বললেন, বাংলাদেশ থেকে যত তরুণই বিভিন্ন সফরে আসেন, তাঁদের সবাই মাস্টার্স পাস! ব্যাপার কী? আমি তাঁর বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, গ্র্যাজুয়েশন নয়, তার আগেই পররাষ্ট্র বিষয়ে তিন-চার বছরের ডিপ্লোমা পাস করে লন্ডন ফরেন অফিসে উঁচু পদে চাকরি করছেন।

আমাদের লক্ষ্য জিপিএ-৫। তারপর সবাই অনার্স-মাস্টার্সের পেছনে ছুটছি। ওদিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে বিশ্ব কোথায় চলে যাচ্ছে, তার খবর রাখি না।

আইআইডির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদ আহমেদ বলেন, তাঁদের জরিপে দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ তরুণ মনে করেন দক্ষতা ও বেকারত্ব তাঁদের প্রধান সমস্যা। এই ৮৪ ভাগ তরুণের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে না পারলে উন্নয়ন, অগ্রগতি—যা কিছুই বলি না কেন, সব ভেসে যাবে।

গণিতের ভাষা দিয়ে বলব, কর্মসংস্থান = সোনার বাংলা। আমরা প্রায়ই বলি পপুলেশন ডিভিডেন্ড। মানে বিপুল জনসংখ্যার সুবিধার অংশটুকু বুঝে নেওয়া। সেটা করতে হলে তরুণদের কাজ দিতে হবে। সবাই যে চাকরি করবেন বা পাবেন, তা নয়। আধুনিক যুগের প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে আর অনুকূল পরিবেশ থাকলে তরুণেরা নিজেরাই কাজের সুযোগ বের করে নেবেন। যাকে আমরা বলি আত্মকর্মসংস্থান।

কিন্তু এখানে একটা কথা। আমাদের দেশে যেসব কারিগরি শিক্ষা ও অন্যান্য কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, তার আধুনিকায়ন দরকার। দুই-তিন যুগ আগের প্রযুক্তি শিখিয়ে আমাদের তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে না। এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। অটোমেশন উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যন্ত চলে গেছে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির এক একটি কেন্দ্রস্থল। আশপাশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শেষ পর্বের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নি হিসেবে নিয়োগ দেবে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাজের দক্ষতা সেখান থেকেই শিক্ষার্থীরা পাবেন। তারপর পাস করে উপযুক্ত দক্ষতা নিয়ে চাকরি করবেন বা নিজেই উদ্যোক্তা হিসেবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুলে বসবেন। সেখানে আরও ১০ জনের চাকরি হবে।

শ খানেক বছর আগে রুশ বিপ্লবের পর লেনিন তাঁর প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বলেছিলেন, বিদ্যুৎ = সমাজতন্ত্র। সরকার বিদ্যুতের কাজটি শুরু থেকেই অগ্রাধিকারে নিয়েছে। এখন আমাদের নতুন ফর্মুলা দরকার। সেটা হলো, তরুণদের কর্মসংস্থান = সোনার বাংলা।

কারণ, চাকরিবঞ্চিত হতাশ, ক্ষুব্ধ তরুণদের নিয়ে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়।

আব্দুল কাইয়ুম, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]