বুলবুল মধু খায়, টুলটুল জেলে যায়!

প্রকৃত আসামি আবু সালেক ও নিরীহ জাহালম
প্রকৃত আসামি আবু সালেক ও নিরীহ জাহালম

বাদী জাহাঁপনাদের কাট্য বা অকাট্য কোনো যুক্তিই ছিল না। তাই আদালত জাহা আলম ওরফে জাহালমের জামিন দিয়েছেন। আদালত জানেন, টালবাহানা কিংবা ফন্দি-ফিকিরের জালে আদালতের রায় বাস্তবায়িত হতে ‘টাইম’ লাগে। আদালতের হয়তো মনে ছিল সাতক্ষীরার জবেদ আলীর কথা। উচ্চ আদালত থেকে তাঁর মুক্তির নির্দেশ কার্যকর করতে ১৩ বছরের বেশি সময় লেগেছিল। ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ উচ্চ আদালত তাঁকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন আর তিনি মুক্তি পান ২০১৬ সালের ৩ মার্চ। কাশিমপুরে যাতে সাতক্ষীরা চর্চা ভর না করে, সে জন্য আদালত এবার রায়ের সঙ্গে সঙ্গে তাগিদও দিয়েছিলেন কালক্ষেপণ না করার। সেই তাগিদের জোরেই হোক আর মিডিয়ার নজরদারির কুদরতেই হোক, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর মুক্তি ঘটেছে।

জাহালম ভাগ্যবান, তাঁকে প্রিন্ট মিডিয়া দেখতে পেয়েছিল। বলে রাখা ভালো, প্রায় এক বছর আগে, ২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম এই অবিচারের তথ্য প্রচার করে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল তাদের অপরাধ অনুসন্ধানীমূলক এক ঈষৎ জনপ্রিয় ও নিয়মিত অনুষ্ঠানে। মূলত, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একটি প্রতারক চক্র কীভাবে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, তারই নানা দিক উঠে এসেছিল সেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। সেখানে পরিষ্কার করেই দেখানো হয়, কীভাবে জালিয়াত চক্র সালেকের তরুণ বয়সের ছবির সঙ্গে জাহালমের ছবির মিল দেখিয়ে তাঁকে জেলে পাঠায়। দেশের সচেতন মানুষ সবাই যে মন দিয়ে টিভি দেখে না, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। দেখলে এই নাটকীয় মুক্তির দৃশ্য কমপক্ষে ১১ মাস আগে আমরা দেখতে পেতাম। আর জাহালমের শিশুকন্যা চাঁদনী তার আকাশের চাঁদ বাবাকে কাছে পেত অনেক আগেই। চাঁদনীকে কারামুক্ত বাবা জাহালমের কোলে দেখে বঙ্গবন্ধুর ডায়েরিতে লেখা, ‘হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃষ্ঠা ১৪৬) বাক্যটিই যেন বারবার মনে পড়ে যায়।

টিভির তাকত বেশি, না কাগজের হেকমত বেশি, সেই বাহাসের জন্য এই লেখা নয়। গত বছর বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে জাহালমের দুর্ভাগ্যের কথা প্রচারিত হয়। দুদকের লোকজন গত বছরই নিশ্চয় সেটা দেখেছিলেন। তখন তাঁরা ভুল স্বীকার করলেন না কেন? তথ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্য যাঁরা সম্প্রচারিত সব অনুষ্ঠান মনিটর করেন, তাঁদের নজরের জালেও বিষয়টি আটকা না পড়ার কোনো কারণ নেই। তাঁরা যদি তখন সক্রিয় হতেন, তবে জাহালম আরও এক বছর আগেই মুক্ত হতেন। তাঁরা কেন তা করেননি, সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন?

এসব প্রশ্ন জিগানোর অধিকার যাঁদের আছে, তাঁরা নিশ্চয় সময়মতো সে খাতা খুলবেন। আমাদের প্রশ্ন, বাকি সব জেল ভালো করে খুঁজে দেখা হয়েছে কি না, আর কোথাও কোনো জাহালম ভুল ঘানি টানছেন না তো? স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. জামান বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করতে চাই, জাহালমের মতো আর কেউ এভাবে বিনা বিচারে কারভোগ করছেন না এবং ভবিষ্যতেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।’ তাঁর আশা সত্যি হলে খুশির চাঁদ উঠবে দেশের আকাশে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে। এই তো সেদিন (২০১৬ সালে) সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার তেতলি এলাকার বাসিন্দা ফজলু মিয়াকে বিনা অপরাধে ২৩ বছর আটক রাখার পর আদালতের নির্দেশে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্ট এলাকা থেকে ফজলুকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তারপর কেউ কিছু জানে না।

অন্য একটি ঘটনায় সিপন নামের এক নিরপরাধ ব্যক্তির ১৬ বছর কারাবাসের বিষয়টি গণমাধ্যমের নজরে এলে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে হাইকোর্ট সিপনকে হাজির করার নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালে আদালত তাঁকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, একটি মামলায় একজন আসামির ১৬ বছর ধরে বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকা রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। বিচার বিভাগও এই লজ্জা এড়াতে পারে না। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হলে সিপনকে এত দিন কারাগারে থাকতে হতো না। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার দায় বিচার বিভাগ, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিপিও এড়াতে পারেন না। জাহালমের মুক্তির সময় আদালত প্রায় একই কথা বলেছেন।

চেহারার সঙ্গে মিল, নামের সঙ্গে মিল, এমনকি কোনো কিছুতেই মিল না থাকলেও জেলে পাঠিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকার উদাহরণ আর তালিকার ফিরিস্তি দিতে গেলে শত খণ্ডেও তা শেষ হওয়ার নয়।

বিনা দোষে পাঁচ বছর কারাবাসের পর ২০১২ সালে জাকির হোসেনকে হাইকোর্টে তলব, নয় বছর বিনা বিচারে আটক থাকার পর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সালেহ আহমদ কালুর জামিনের নির্দেশ, খুলনার রওশন মণ্ডল, সাতক্ষীরার নজরুল ইসলাম কিংবা মানিকগঞ্জের শুকুর আলীর কথা কি আমরা ভুলে গাছি? আইনের মারপ্যাঁচে শুকুর আলী কি এখনো শুয়ে আছেন কোনো এক কনডেম সেলের কোনাকাঞ্চিতে? এঁদের কথা আমরা জেনেছি হয় কোনো সাহসী কর্মঠ সংবাদকর্মীর নিরলস পরিশ্রম অথবা কোনো মানবাধিকারকর্মীর অনুশীলনের মাধ্যমে। এসবই বিকল্প মাধ্যম। ভুল করে, ষড়যন্ত্র বা কারসাজির মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষকে আটকে রাখার তথ্য বা ভুল প্রক্রিয়ায় মামলা চালিয়ে হয়রানি করার কাহিনি আদালত বা প্রশাসনের কাছে তুলে ধরার আইনসিদ্ধ নিয়মিত উপায় কোথায়? তা না থাকায় অনেকেই—বিশেষ করে যাঁদের টাকাপয়সা নেই—নানা ষড়যন্ত্রের সহজ শিকারে পরিণত হয়ে বিনা কারণে জেল–হাজতে আটকে থাকছে, আবার কখনো একজনের বদলে শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছে অন্যজন।

ভুল, ষড়যন্ত্র বা কারসাজি মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষকে যে জেলের ঘানিতে টেনে আনার মানুষের অভাব হবে না, সেটা আন্দাজ করেই ১৮৯৪ সালে প্রণীত কারাবিধি বা জেল কোডে নিয়মিত কারা পরিদর্শনের বিধান রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও প্রতিটি কেন্দ্র, জেলা ও সাবসিডিয়ারি জেলে বেসরকারি ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কারা পরিদর্শন দল গঠনের নির্দেশ দেওয়া আছে কারা বিধিতে। বিধি অনুযায়ী (জেল কোড-আর ৫৭) প্রতিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন—এমন সমাজসচেতন নাগরিকদের মধ্য থেকে চারজন নারী ও ছয়জন পুরুষ এবং জেলা কারাগারে দুজন নারী ও তিনজন পুরুষ আর সাবসিডিয়ারি জেলের জন্য একজন নারী আর দুজন পুরুষকে জেল পরিদর্শক মনোনীত করার বিধান আছে। রাজনীতি সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জেল পরিদর্শকের দায়িত্ব না দেওয়ার রেওয়াজ আবার চালু করে সমাজসচেতন ব্যক্তিদের নিয়ে জেল পরিদর্শকদের কর্মকাণ্ডকে বেগবান করলে জাহালমদের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কমবে।

পদাধিকার বলে সংশ্লিষ্ট বিচারক ও বিচারপতিরা নিয়মিত জেল পরিদর্শনের এখতিয়ার রাখেন। সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির কাশিমপুর জেল পরিদর্শনের বয়ান দিয়ে এ লেখার ইতি টানব।

একটি খুনের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলে কপাল পোড়ে বাবুলের। ডেমরা থানার মামলা নম্বর-১৫৩(১২)৯৮। এ মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি বাবুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারপর কেটে যায় ১৭টি বছর। ২০১৬ সালে তিনি সুযোগ পান একজন জেল পরিদর্শকের সঙ্গে কথা বলার। তিনি ছিলেন একজন প্রধান বিচারপতি। তাঁকে বাবুল আদ্যোপান্ত খুলে বলেন। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি নিয়ে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত বাবুলকে নির্দোষ হিসেবে খালাস দেন। এ বিষয়ে সে সময় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, পুলিশ এ রকম মামলা দিয়ে মানুষকে বিপদে ফেলে। গরিব মানুষ তদবির করতে পারে না। আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। জেলখানা যাঁদের নিয়মিত পরিদর্শন করার কথা, তাঁদের প্রত্যেকেরই অবহেলা রয়েছে। নইলে ১৭ বছর একজন বিনা অপরাধে আটক থাকতে পারেন না।

আমাদের সংবিধানিক কাঠামো আর ব্যবস্থাগুলোকে রাজনীতির বাইরে রেখে বিধানমোতাবেক চলতে দিলে ভারসাম্য রক্ষার পথ থাকবে, আইনের অপপ্রয়োগ কমবে আর আইনপ্রয়োগকারীদের পা পিছলানোর দরজাটাও ছোট হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক, গবেষক