বিএনপি কোন পথে যাবে?

বিএনপি
বিএনপি

টানা ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। সর্বশেষ নির্বাচনে চরমভাবে বিপর্যস্ত। না মাঠে, না কৌশলে—কোনোভাবেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পেরেছে। কারণ, বিপুল জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই দলটির নেতা–কর্মীদের অনেকেই হতাশ। বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতাবলয়ের কাছাকাছি থেকে সুবিধা লাভের চিন্তা করেন। কিন্তু যাঁরা প্রকৃতই রাজনীতিবিদ, তাঁরা এখান থেকে নতুন দিনের দিশা খুঁজে পাচ্ছেন। সরকারের ওপর জনসাধারণ সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু বিএনপি সরকারের অজনপ্রিয়তার সুযোগও নিতে পারেনি। বিএনপির নেতৃত্বের দুর্বলতা, সময়কে অনুধাবনের অক্ষমতা, একগুঁয়েমি, বিভিন্ন পর্যায়ে যোগ্য ও দক্ষ নেতা নির্বাচনে ব্যর্থতার কারণেই দীর্ঘ সময় ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে। বিএনপি সরকারে নেই, সংসদে নেই, মাঠেও নেই। প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অবস্থান কোথায়? কেবল ঘরোয়া বৈঠক ও বিবৃতির জোরে বিএনপি এ অবস্থায় কী করতে পারবে?

এ অবস্থায় বিএনপির সামনে দুটি পথ খোলা। প্রথমত, নির্বাচনে পরাজয়ের পর হতাশায় আরও মুষড়ে যাওয়া অর্থাৎ বিএনপির প্রচলিত রাজনীতিকে ধারণ করে জনবিচ্ছিন্ন হতে হতে কোনোরকমে টিকে থাকা এবং যদি কখনো কিছু হয় সেই ভরসায় বসে থাকা। অপরটি হচ্ছে দলকে গুছিয়ে আবার রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় হওয়া; গোড়ালি শক্ত করে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা।

বিএনপি অবশ্যই নিষ্ক্রিয় না। তবে এখন যা করছে তাকে ঠিক সক্রিয়তাও বলা যায় না। বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হতে পারে, দলের কয়েক লাখ নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা আছে। গুম, খুনও কম হয়নি। নির্বাচনের আগে বিএনপির অনেক নেতা–কর্মীকে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তাড়া খেয়ে ধানখেতে পর্যন্ত ঘুমাতে হয়েছে। বিএনপির ওপর এত দমন–পীড়নের পরও জনসাধারণকে কেন বিএনপি পাশে পাচ্ছে না? অথচ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বা কোটা সংস্কার আন্দোলন তো অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু বিএনপি পাচ্ছে না। কারণ, গত ১২ বছরে গণবান্ধব কোনো কর্মসূচি বিএনপি দেয়নি। জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়েই বিএনপির জোরালো বক্তব্য ছিল না। জাতীয় স্বার্থ বিষয়ে বিএনপির কোনো কর্মসূচি ছিল না। বিএনপি কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়েছে। এসব কারণে বিএনপি কিছুটা জনবিচ্ছিন্নও হয়েছে বটে। দেশে মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটছে। এরা সচেতন। এই মধ্যবিত্তের বড় একটি অংশই মনে করে এখন আওয়ামী লীগ বা মহাজোট যা করছে, বিএনপি বা তাদের জোটও ক্ষমতায় গিয়ে তাই করবে। বরং বেশিই করতে পারে। তাই এই মধ্যবিত্ত এখন আর লুটপাট, দখলদারের পালাবদলের নিয়ামক হতে চায় না। এই মধ্যবিত্ত, সাধারণ মানুষকে বিএনপির আস্থায় আনতে হবে। বোঝাতে হবে, আমরা ক্ষমতায় গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

জনগণের সাড়া ব্যতীত বিএনপির পক্ষে বড় কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হতে পারে, আওয়ামী লীগের প্রতিও তো তেমন জনসমর্থন নেই। তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারে টিকে আছে কী করে? কারণ হচ্ছে সরকারি দল সব সময় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের সুযোগ পায়। এই সুযোগ বিএনপিও পেয়েছে। ব্যবহারও করেছে। কিন্তু টিকতে পারেনি। আওয়ামী লীগ পারছে। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তিক স্তর ও দক্ষতার সঙ্গে বিএনপির বিশাল পার্থক্য রয়েছে। কর্মীদের আচরণে পার্থক্য আছে। মাঠ গরমের রাজনীতি আওয়ামী লীগ বা অন্যরা করতে পারলেও বিএনপি কতটুক পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তাই প্রচলিত হরতাল, অবরোধের রাজনীতি থেকে বিএনপিকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এখান থেকে বের হতে হলে নির্বাচনী পরাজয়কে বিএনপির ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে হবে। এই পরাজয় দল পুনর্গঠনের বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছে বিএনপির সামনে। সাধারণত ক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর পুনর্গঠন সম্ভব নয়। সরকারে থাকলে নানা ধরনের ধান্দা–ফিকির কাজ করে কর্মীদের মাথায়। অনেক দেনা–পাওনার হিসাব থাকে। টেন্ডারবাজি, দখল, পাল্টা দখল, এলাকা নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জলমহাল, বালুমহাল, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ—হাজারো চিন্তা থাকে কর্মীদের মাথায়। এখন যেহেতু সরকারে নেই, তাই বিএনপির সামনে বিশাল সুযোগ। প্রকৃত অর্থেই একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার। বাংলাদেশে কোনো দলই নিজেদের জনবান্ধব রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে পারেনি। বিএনপি এই সুযোগ নিতে পারে। যেটা অন্য কোনো দলের পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ এখন সরকারে। নানা হিসাব–নিকাশ নিয়ে আওয়ামী লীগকে ব্যস্ত সময় পার করতে হবে। আবার বাম, ইসলামপন্থী দলগুলোর তেমন জনসমর্থনও নেই। তাই এই সুযোগে বিএনপি ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ঘরানার উদারপন্থী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিএনপিকে মোটা দাগে চারটি কাজ করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। নেতা–কর্মীদের ক্ষমতায়ন করে অধিকতর গণতান্ত্রিক ভাব আনতে হবে দলে ভেতরে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিশোধন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ নীতি বলতে দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কে মাত্রা কী হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। এর পাশাপাশি বিএনপির নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো দাঁড় করা হবে। প্রতিপক্ষকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবিলার জন্য নিজস্ব আদর্শিক বয়ান দাঁড় করানোর মতো বুদ্ধিজীবীর দল বিএনপিতে আছে বলে মনে হয় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জাগরণের প্রয়োজন হতে পারে। তবে বিএনপি কি দেশের অন্যতম প্রধান দল হিসেবে এর নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত?

সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বিএনপির দুই বর্ষীয়ান নেতা আইনজীবী মওদুদ আহমদ ও ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, নতুনদের নেতৃত্বে আনতে হবে। প্রয়োজনে প্রবীণেরা নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন। ভালো কথা। কিন্তু এই নেতৃত্বের পরিবর্তন যেন গণতান্ত্রিকভাবে হয়। অমুক ভাই, তমুক ভাইয়ের লোকজন যেন নেতৃত্বে না আসতে পারে। দলের ভেতর দক্ষ ও যোগ্যরাই নেতৃত্বে আসতে পারেন, সেই উদ্যোগ বিএনপিকে নিতে হবে। দলের ভেতরে গণতন্ত্র না এলে কোনো দলই দেশে গণতন্ত্র কায়েম করতে পারবে না। বাস্তবেও তাই হচ্ছে। দেশে কোনো দলেই গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। বিএনপি প্রথম দল হিসেবে এই সুযোগ নিতে পারে। একদম তৃণমূল থেকে প্রতিটি কমিটি স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ভোটে নির্বাচিত হতে পারে। এর জন্য সময় লাগবে, কিন্তু জটিল ও কঠিন কোনো বিষয় নয়। জেল থেকে বা নেতা বিদেশে থেকে দল পরিচালনা করতেই পারেন। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? স্থানীয় পর্যায়ে দলকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে। কর্মীদের ক্ষমতায়ন করতে হবে। কর্মীরা যেন ভাবতে পারেন নেতা আমার দ্বারা নির্বাচিত, দলের এই সিদ্ধান্ত আমার, ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নয়। জার্মানিতে সরকার গঠনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে যাবে কি না, এ নিয়ে দলের ভেতরে ভোটাভুটি হয়েছে। বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে যাবে কি না তা নিয়ে প্রতিটি ইউনিটের নেতারা ভোট দিতে পারেন। ভোট দেওয়ার আগে নেতারা স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা বা ভোটাভুটি করে নিতে পারেন।

আরেকটি বিষয়, বিএনপির ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের আনতে হবে। বুড়ো, বিবাহিত, অছাত্রদের নিয়ে চাঁদাবাজি, হল দখল, টেন্ডারবাজি করানো যায়, দল দাঁড় করানো যায় না। তাতে করে জনসমর্থনও থাকে না, নেতৃত্বেরও বিকাশ ঘটে না। দেশে ছাত্ররাজনীতি ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য বিএনপি অনেকটাই এককভাবে দায়ী। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার সময় দেশের কমবেশি সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত সংসদ ছিল। এবং বেশির ভাগ সংসদই ছাত্রদলের দখলে ছিল। কিন্তু এরপর বিএনপি শিক্ষার্থী সংসদের নির্বাচনই আয়োজন করতে পারেনি। এ কারণে বিএনপির নতুন নেতৃত্বও তৈরি হয়নি। যে কারণে বিএনপি এখন ভুগছে। শুধু বিএনপি কেন, ছাত্ররাজনীতিই এখন ধুঁকছে।

বিএনপি কি এসব শুনবে? নাকি এসব কথা বলা যেন উলু বনে মুক্তা ছড়ানো? বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এসব প্রস্তাব অনেকের কাছেই ইউটোপীয় মনে হতে পারে। কিন্তু বিএনপিকে টিকতে হলে এ বাস্তবতা বুঝতে হবে। ভোটের ধারা বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশে। নতুন ভোটাররা যুক্ত হচ্ছেন। ভোটের মানচিত্রও দ্রুত নতুনভাবে গঠিত হচ্ছে। নব্বই বা আশির দশকের স্লোগান দিয়ে জনসমর্থন আদায় করা যাবে না। ভবিষ্যতের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার বা মৌলবাদ ইস্যু খুব শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে না। বরং বৈষম্য ও দুর্নীতির বিষয়গুলো সামনে আসবে। ইতিমধ্যে দেশে বৈষম্য বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিতে পারে, সেটা দেখার বিষয়। কিন্তু এ বিষয়গুলোর যথাযথ ব্যাখ্যা তৈরি করতে না পারলে বিএনপিকেও ভুগতে হবে।
যাঁরা মনে করছেন বিএনপি হারিয়ে যাবে বা গেলে ভালো। বিএনপি হারিয়ে গেলে তা আওয়ামী লীগের জন্যও ক্ষতিকর হবে। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে আওয়ামী লীগ নানা ধারায় বিভক্ত হয়ে ব্র্যাকেটবন্দী হয়ে পড়তে পারে। বিএনপিতে যদি পরিবার না থাকে, তবে আওয়ামী লীগেও পারিবারিক ধারার আবেদন কমতে পারে।

এ শুধু নিজেদের বদলে দেওয়া নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোই বদলে দেওয়ার নেতৃত্ব দিতে পারে বিএনপি। বিএনপি এই সুযোগ নেবে, না হারিয়ে যাবে—তা বিএনপির ওপরই নির্ভর করছে। নিজেদের প্রস্তুত করতে পারলে জনগণই বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। ইতিহাসে এর উদাহরণ আছে।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন