জিরো টলারেন্স-যেই লাউ সেই কদু

২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত মিজানুর রহমান খানের অভিমতের শিরোনাম ছিল ‘জিরো টলারেন্স থেকে মাইনাসে নামুন’। এর আগের দিন, অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ডেইলি স্টার-এর প্রথম পাতায় নিউজ অ্যানালিসিস হিসেবে শাখাওয়াত লিটনের ‘ডেমোক্রেসি ভার্সাস গ্রাফ্ট’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। লেখাটি কিছুটা হলেও ওই দুই লেখার ধারাবাহিকতায়, তবে সম্ভবত আরও কিছুটা চাঁছাছোলা। বলাবাহুল্য, মূল্যায়নের ভার পাঠকের। একদিকে টিআইয়ের সাম্প্রতিকতম দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ এবং ধারেকাছের সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারপ্রধানের জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা থেকেই এ গোছের আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত।

১ জুলাই ২০১৬ হোলি আর্টিজানে বীভৎস হত্যাযজ্ঞের পর সরকারের ঘোষিত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে নিঃসন্দেহে সুফল এসেছে। গত আড়াই বছরে ছোটখাটো গুটিকয়েক ঘটনা ছাড়া বড় কোনো জঙ্গি তৎপরতায় নিরীহ মানুষের প্রাণহানি হয়নি। এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন আখড়ায় অভিযান চালিয়ে ভালো সাফল্য পেয়েছে। জঙ্গিরা নিহত হয়েছে অথবা ধরা পড়েছে। হোলি আর্টিজানের মামলায় ৮ অভিযুক্তের সবাই এখন জেলে। বিচার শুরু হচ্ছে। এসব নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় সাফল্য।

ছয় মাসের বেশি হলো মাদকের বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স নীতিতে শুরু হয়েছে সরকারের পথচলা। সরকারের এই অভিযানের পর বেশ কয়েকবার সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে যে মাদক কারবারিরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সম্ভবত সরকারের অভিযান সফল করার জন্য নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বন্দুকযুদ্ধে একে অপরকে খতম করছে। বলাবাহুল্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে খতম হয়েছে বহু মাদক কারবারি। টেকনাফ এলাকায় মাদক কারবারিদের অট্টালিকা-প্রাসাদের অনেক ছবি ইদানীং সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সংবাদও মিডিয়ায় এসেছে। এখন জিরো টলারেন্স হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

দুই.
হোলি আর্টিজানের হত্যাযজ্ঞের পর যখন জানা গেল যে ঘটনাটির সঙ্গে অভিজাত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র জড়িত ছিল, তখন তা নিয়ে দেশব্যাপী হুলুস্থুল হয়েছিল। উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা কীভাবে সন্ত্রাসী-অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেল, সেই ইস্যুতে টক শো, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট স্কুলে প্রচুর আলাপ-আলোচনা হলো। অবশ্য পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যারা মারা ও ধরা পড়েছিল, তাদের মধ্যে উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত গোছের আর কেউ ছিল বলে মনে পড়ে না। একইভাবে ইয়াবা বা মাদক কারবারি যারা নিজেরা নিজেদেরই বন্দুকযুদ্ধে মারছে অথবা অন্যান্য বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে, তাদের মধ্যে ‘বড়লোক’ এখনো পাওয়া যায়নি। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, চুনোপুঁটিরাই মারা-ধরা পড়ছে। রাঘববোয়াল-গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ইদানীং সাধারণ এক হিসাবরক্ষকের শতকোটি টাকার দুর্নীতির খবরে হইহই-রইরই হচ্ছে। এ গোছের চুনোপুঁটি ব্যতীত ধারণা করছি, বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা রাঘববোয়াল বা উচ্চবিত্ত। একটা ব্যাংকের সাধারণ হিসাবরক্ষক বা ক্যাশিয়ার কত টাকাই-বা চুরি করবেন। কিন্তু ব্যাংকের চেয়ারম্যানের জন্য শতকোটি টাকা কোনো ব্যাপারই না। যে কোম্পানি শত শত কোটি টাকার সরকারি কাজ পায়, তার কর্ণধার তো ২০-৩০ হাজার টাকার কারবারি হবেন না। মোদ্দা কথা, জঙ্গি আর ইয়াবা কারবারিদের তুলনায় বড় দুর্নীতিবাজদের জাত-মান সম্পূর্ণ ভিন্ন কিসিমের। এখানেও জিরো, ওখানেও জিরো। কিন্তু এই দুই জিরো নীতির বৃত্ত দুটির আকৃতি এক ও অভিন্ন হবে না।

ইদানীং জানলাম, দুদক ছুটছে মফস্বলের ডাক্তার আর শিক্ষকদের উপস্থিতির খুঁজে। তাঁদের অনেককেই কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। বেশ হম্বিতম্বি হলো। মফস্বলের ডাক্তারদের নিয়ে টক শোতে ঝড় বইল। তাই বলছিলাম, এই জিরো আর ওই জিরো এক না।

তিন.
টিআইয়ের ধারণাসূচকে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর নাম দেখছি না। প্রতিবেশী অর্থ আমাদের মতোই, যাদের দুর্নীতি অনেক বেশি, টিআইয়ের ধারণাসূচকে নিচের দেশগুলো। তালিকার সবচেয়ে নিচে অর্থাৎ ধারণাসূচকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হলো সোমালিয়া। নিচের দিক থেকে সোমালিয়ার ওপরে সিরিয়া। শাসক বাশার আল-আসাদ, দেশ শাসন করছেন ২০০০ সাল থেকে। যত দূর মনে পড়ে, পরপর তিনটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বাশার আল-আসাদের আগে সিরিয়া শাসন করেছেন তাঁর বাবা হাফেজ আল-আসাদ ১৯৭১ থেকে ২০০০ পর্যন্ত। বাপ-বেটা মিলে প্রায় অর্ধশতাব্দী। সিরিয়ার ওপরে সাউথ সুদান, মোটামুটি সদ্য স্বাধীন। তাই লম্বা শাসনামলের খাতা এখনো খোলা হয়নি। তার পরেই ইয়েমেন। আলী আবদুল্লাহ সালেহ, ১৯৯৪ থেকে ২০১২। ইদানীং ইয়েমেনে সৌদি বনাম ইরানের প্রক্সি যুদ্ধ চলছে। অকাতরে নিরীহ মানুষ প্রতিদিনই মারা পড়ছে। ইয়েমেনের ওপরে উত্তর কোরিয়া। তিন শাসক মিলিয়ে পার করেছেন ৭০ বছরের বেশি সময়। এরপরে সুদান। শাসক উমর আল বশির তখতে আছেন ১৯৮৯ থেকে। এই তো সেদিন দেশটাকে ভালো করার, উন্নতি করার গুরুদায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে তিন দশক। অর্জিত হয়েছে বেবাক-অফুরন্ত দুর্নীতি। সুদানের ওপরে ইকুয়েটোরিয়াল গিনি। বাবাজানের নাম অনেক লম্বা-টোডোরো ওবিয়াং এঙ্গুয়েমা এমবাসোগো, দেশটির দায়িত্বে আছেন টানা ১৯৮২ থেকে। পইপই করে সব দেশের ফিরিস্তি না দিয়ে দুর্নীতি সূচকে যারা আমাদের কাছাকাছি, তাদের মধ্যে থেকে দু-চারজন বিশালকায় নেতা অথবা বাপ-বেটার নাম যত্নের সঙ্গে বলতেই হবে। আমাদের মতো ১৪৯ তম স্থানের আরেকটি দেশ হলো উগান্ডা। ইয়োরি মুসোভেনি আছেন ১৯৮৬ থেকে। ফিরিস্তি শেষ করার আগে একটু ওপরে তাকাই। আমাদের থেকে একটু ভালো অবস্থানে আছে টোগো। বাপ নাসিম্বে ছিলেন ১৯৬৭ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত, এখন ছেলে নাসিম্বে দেশ চালাচ্ছেন বাপের পরে অর্থাৎ, ২০০৫ থেকে। গ্যাবনে বাবা অন্দিম্বা চালিয়েছেন ১৯৬৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত। তারপর থেকে দেশ চালাচ্ছেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র আলী বোঙ্গো অন্দিম্বা। পড়তেও ভালো লাগে, গর্বেও বুক ভরে যায়। বাপ-বেটা মিলে চালাচ্ছেন কমবেশি অর্ধশতাব্দী। দুর্নীতি তো অর্জিত হবেই।

চার.
বলাবাহুল্য, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে এই সব দেশে তাদের স্ব স্ব দুদক নেই। টোগোর দুদকের নাম হলো ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর ফাইটিং করাপশন অ্যান্ড ইকোনমিক ক্রাইম’। প্রতিষ্ঠানের নামের মধ্যেই জিরো টলারেন্স ফাইটিং। ফাইটিং শব্দটি শুনলে ব্রুস লি আর জ্যাকি চ্যানের এক হাতে ডজন ডজন ভিলেন কাবু করে দেওয়ার সিনেমার চিত্রগুলো ভেসে আসে। আফ্রিকার দেশ গ্যাবনে কয়েকজন মন্ত্রী এবং সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে অনেক হুলুস্থুল করে দুর্নীতির মামলা শুরু হয়েছে ২০১৮-এর মার্চে। তবে ওই দেশে দুদক আছে কি না, সেটা ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজে পাচ্ছি না। ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’-এর পৃথিবীর দেশগুলোর গণতন্ত্রের সূচকে চার ধরনের গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। অধমের নিজের বোঝার সুবিধার জন্য এই চার স্তরের নাম দিয়েছি ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, থার্ড ডিভিশন অ্যান্ড ফেল ডিভিশন। এই সূচকে আমরা আছি থার্ড ডিভিশনে। ইকোনমিস্টের মতো বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান না হলেও ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টে আইনের শাসনের সূচকটি ফেলনা নয়। এই সূচকে বিশ্বের ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২ তম স্থানে।

যে নির্বাচন হলো, ভোটাভুটি শুরু হওয়ার আগেই যেখানে অনেক ভোটাভুটি হওয়ার অভিযোগ; যেখানে বিচার বিভাগের ওপর আস্থা হঠাৎ হঠাৎ বাড়লেও সাধারণভাবে আস্থা নিম্নমুখী; যেখানে প্রশাসন-পুলিশের কেউ কেউ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের চেয়ে সরকারি দলের কর্মী বাহিনীর ভূমিকায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং দুদক রাঘববোয়ালের পরিবর্তে চুনোপুঁটি নিয়েই বেশি ব্যস্ত, সেখানে জিরো টলারেন্স শুধু একটা রাজনৈতিক স্লোগানের চেয়ে কাজের কাজ কিছু করতে পারবে কি?

ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক