কী ঘটছে আরাকানে? কারা এই আরাকান আর্মি?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের নাম পরিবর্তনের সূত্রে সেখানকার সরকারি দলিলপত্রে আরাকানকে এখন ‘রাখাইন’ নামে ডাকা হয়। রোহিঙ্গাদের দুঃখ-কষ্ট-গণহত্যার সূত্রে আরাকান বহির্বিশ্বেও ইতিমধ্যে পরিচিত এক জনপদ। এবার তাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন উপাদান। ১০ লাখ রোহিঙ্গার পর এবার আরাকান ও পার্শ্ববর্তী চিন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চিন, খুমি ও ম্রো জাতিসত্তার মানুষ। কিন্তু এবারের সংকটের কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আরকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সংঘাত থেকেই নতুন উদ্বাস্তু সংকটের জন্ম। আরাকান আর্মি রাখাইন অঞ্চলের স্বাধিকারের জন্য লড়ছে। তবে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে বান্দরবানসংলগ্ন চিন প্রদেশেও।

পরাভূত আরাকানের স্বাধীন অতীত
আরাকানে মিয়ানমারের বামার জাতিসত্তার শাসন শুরু ১৭৮৪ থেকে। আর ব্রিটিশ শাসন শুরু ১৮২৬ থেকে। ১৯৪২ থেকে দুই বছর এই এলাকা ছিল জাপানি শাসনে। ব্রিটিশ শাসকেরা চলে যাওয়ার পর ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয় আবার বামারদের শাসন। অথচ ১৭৮৪-এর আগে আরাকান স্বাধীন সত্তা হিসেবেই ছিল। বর্তমান আরাকানের আয়তন ১৮ হাজার ৫০০ বর্গমাইল। অতীতে তা আরও বড় ছিল।

মিয়ানমারে ব্রিটিশ আগ্রাসনের সূচনা আরাকানে বামারদের আগ্রাসনের সূত্রেই। বামাররা আরাকান দখলের পর প্রচুর আরাকানি কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয় এবং সেখানে থেকে স্বাধীনতাসংগ্রাম অব্যাহত রাখে। সে সময় প্রায় স্থায়ী প্রতিরোধ যুদ্ধের কারণে আরাকানে বামার রাজাদের শাসন মোটেই স্বস্তির ছিল না। বামাররা মনে করত, এর পেছনে বাংলা থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইন্ধন আছে। এভাবেই আরাকানের ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে ব্রিটিশদের প্রথম যুদ্ধ বাধে। তাতে বামাররা আরাকান ও আসাম হারায়। এ সময় আরাকানের প্রবাসী নেতৃত্ব ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ১৮২৪ সালে এই মর্মে একটি চুক্তিও হয় যে যুদ্ধে জয়ী হলে আরাকান ও ব্রিটিশরা পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্কে আবদ্ধ হবে। আরাকানিদের পক্ষে এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আং খইয়ে জান। এই যুদ্ধে বামাররা পরাজিত হলেও আরাকান আর স্বাধীনতাসংগ্রামীদের হাতে ফিরে আসেনি, সেটা আরেক ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়।

এ সময় দুই প্রধান জাতীয়তাবাদী নেতা আং খইয়ে জান ও আং খ রিহি এবং যুবরাজ শউই বানকে ব্রিটিশরা আটক করে এবং ১৮৩৪ সালে ঢাকা কারাগারে অনশনরত অবস্থায় তাঁরা মারা যান। এরপর আরাকানে বহুবার ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হলেও তা সহজেই দমিত হয়েছে। এসব বিদ্রোহের ব্যর্থতার পটভূমিতে ১৯১৮ সালে জন্ম নেয় রাখখাপুরা লিগ ও ১৯৩০ সালে জন্ম নেয় আরাকান লিগ। ঐতিহাসিক এ ধারাবাহিকতারই আরেক শাখা ইউনাইটেড আরাকান লিগ। এই লিগেরই সশস্ত্র শাখা আজকের বহুল আলোচিত ‘আরাকান আর্মি’।

আরাকান আর্মি কাচিন থেকে ঢুকছে; যুদ্ধ থামাতে চাইছে চীন
১৭৮৪ থেকে শুরু হওয়া আরাকানি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একটি বড় দিক হলো এটা মূলত বৌদ্ধ নেতৃত্বপ্রধান। আরাকান আর্মিও তার ব্যতিক্রম নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে একে ‘এএ’ বলে উল্লেখ করা হয়। মূলত আরাকানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হলেও এএর ঘাঁটি এলাকা কাচিনে এবং সামরিক কার্যক্রম বিস্তৃত বান্দরবানসংলগ্ন চিন ও আরাকান এলাকায়। ২০০৯ থেকে এদের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এই লেখা তৈরির সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির যে দুই থেকে তিনটি সশস্ত্র সংগঠনের ব্যাপক যুদ্ধাবস্থা চলছে, তার মধ্যে এএ একটি। কেন্দ্রীয় সরকার এএর সঙ্গে যুদ্ধবিরতিরও চেষ্টা চালাচ্ছে।

এএর নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ মুহূর্তে মেজর জেনারেল থন¤ম্রাট নইং (Twan Mrat Naing)। ইউনাইটেড আরাকান লিগেরও (ইউএলএ) প্রধান তিনি। একই ব্যক্তি উভয় সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন। নাইও থং অং হলেন এই দলের সাধারণ সম্পাদক। ইউএলএ এবং এএ মনে করে, মিয়ানমার ১৭৮৪ সাল থেকে আরাকানকে দখল করে রেখেছে এবং তারা ঔপনিবেশিক শক্তি। ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিলে দ্য ইরাবতীতে প্রকাশিত থন ম্রাট নইংয়ের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, চীন খুব চেষ্টা করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে এএর সমঝোতা প্রতিষ্ঠার। এর কারণ আরাকানে চীনের বিপুল বিনিয়োগের সুরক্ষার প্রশ্ন।

রাজনৈতিকভাবে আরাকানভিত্তিক হলেও এএর ক্যাডারদের অবস্থান মুখ্যত কাচিন এলাকায়। সেখানে লাইজা অঞ্চলে এদের সদর দপ্তর। অনেক দিন থেকে ব্যাপক সংখ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়েও তারা আরাকানে ঢুকতে পারছিল না। তবে গত দুই থেকে তিন মাসে তারা অনেক সফল। রোহিঙ্গাদের বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশে আগমনের পর থেকে এএ তাদের সামরিক কৌশলে পরিবর্তন এনে কিছুটা আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারিতে আরাকানের স্বাধীনতা অবসানের ২৩৩তম বার্ষিকীতে দক্ষিণ আরাকানের মারাউক-উ এলাকায় এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে মিয়ানমারের পুলিশদের হামলার মধ্য দিয়ে পুরো অঞ্চলে এএ কর্মীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘাত তীব্রতা পায়। এখন আকিয়াব এলাকায় প্রায়ই বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

এএর শক্তি–সামর্থ্য
প্রায় চার হাজার যোদ্ধা রয়েছে আরাকান আর্মির। ২০১৫ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বান্দরবান সীমান্তে এএ গেরিলাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদেরও বড় ধরনের এক সংঘর্ষ ঘটে বলে এএ দাবি করেছিল। এএর পরিবহনকাজে ব্যবহৃত কয়েকটি ঘোড়া বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ে নেওয়া ছিল এই সংঘর্ষের তাৎক্ষণিক কারণ। পরবর্তীকালে এরূপ আর কোনো সংঘাতের খবর প্রকাশিত হয়নি। বর্তমানে চিন, কাচিন ও আরাকানজুড়ে বিভিন্ন স্থানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে এএ ক্যাডারদের সংঘর্ষ ঘটছে। তবে প্রধান এক সংঘর্ষস্থল হলো চিন স্টেটের পালিতওয়া। বান্দরবান সন্নিহিত কালাদন নদীর পাড়ের এই স্থান বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত। এই এলাকায় মূলত খুমি-চিনদের বসবাস। এখানের বাসিন্দারাই এখন রুমা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। আরকানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বলছে, এরূপ উদ্বাস্তুপ্রবাহ আরও বাড়তে পারে। ইতিমধ্যে বামার সেনাপতিরা এএকে লক্ষ্য করে ‘চোখের বদলে চোখ’ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

উল্লেখ্য, এএ হলো মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের অপর গেরিলা গ্রুপ ‘আরাকান লিবারেশন আর্মি’ বা এএলএর থেকে পৃথক একটি সংগঠন। এএলএ হলো আরাকানের সবচেয়ে প্রাচীন গেরিলা দল। যারা গড়ে উঠেছিল মূলত কারেনদের সহায়তায়। অতীতে এরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে অনেক সংঘাতে অবতীর্ণ হলেও বর্তমানে যুদ্ধবিরতিতে রয়েছে (২০১৫ থেকে) এবং তাদের সাংগঠনিক অবস্থাও অত্যন্ত দুর্বল। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনাভিযানে এএলএর ভূমিকা ছিল সহায়কের। যদিও একদা (গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে) এএলএ এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি সংস্থা (আরএসও) একই সঙ্গে আরাকানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করেছে।

অন্যদিকে, এএ ও এএলএর সম্পর্কও এখন শত্রুভাবাপন্ন। এএ ক্যাডাররা প্রায়ই আরাকান-চিন সীমান্তে এএলএর বিভিন্ন চৌকিতে হামলা চালিয়ে তাদের উপস্থিতি দুর্বল করে দিচ্ছে।

আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এবং আরাকানে নাগরিক মর্যাদাসহ তাদের বসবাসের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের চেয়ে অনেক নমনীয়। রোহিঙ্গাদের আরাকানে কোনো ডিটেনশন সেন্টারে রাখারও বিরোধী এএ। এই সংগঠনের প্রধান মেজর জেনারেলথন ম্রাট নইং মনে করেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই একটা জাতি, তবে তারা বাঙালি।’

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক