একটি নিখোঁজ বিষয়

তিস্তা নদী: শীত মৌসুমে যেন মরুভূমি
তিস্তা নদী: শীত মৌসুমে যেন মরুভূমি

রংপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার এবং পীরগাছা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে ছাওলা ইউনিয়নে তরুণ মাসুদ রানাদের বাড়ি। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ালেখা করেছেন। চাকরি পাচ্ছেন না কোথাও। তিস্তার প্রবাহের কয়েক শ গজের মধ্যে তাঁদের জমিজমা। দেড় একরে চাষাবাদ রানাদের। এখানে জমিগুলো তিন ফসলি তো বটেই—মাঝেমধ্যে চারটা আবাদও হচ্ছে। কিন্তু চাষে খরচ বাড়ছেই কেবল। এককালে এখানে তিস্তার প্রশস্ততা ছিল দুই কিলোমিটারের বেশি। এখন পানি বলতে কিছু নেই। থোকা থোকা চর পড়ে আছে। আবাদ হচ্ছে সেখানে। কিন্তু স্বস্তি নেই কোনো চাষি পরিবারে। অনেক টাকা চলে যায় আবাদে।

পার্শ্ববর্তী এলাকার সাদেকুল ইসলামেরও একই কথা। এখানে জমির হিসাব ২২ শতাংশে এক ‘দোন’। সাদেকুল ইসলামদের পরিবার ২০ দোনে রসুন, আলু ও বাদাম করেছে। মার্চেই খরার মতো অবস্থা। খেতে তিন দিন পরপর পানি দিতে হয়। নিজেদের শ্যালো ইঞ্জিনচালিত সেচযন্ত্র থাকলে খরচ কিছু কম পড়ে। কিন্তু তা কিনতে ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে। প্রতি দোনে বছরে প্রায় দুই হাজার টাকা সেচ খরচ বেশি লাগছে।

আবাদ ছাড়া কিছু করার নেই এখানকার তরুণদের। কিন্তু সেচ খরচ বাড়ায় উৎপাদিত ফসলের দাম পড়ছে অনেক বেশি। বাজারে টিকতে পারছেন না আবাদকারীরা। তিস্তাপারের সাদেকুল ও রানাদের দুঃখ হলো বিভাগীয় সদর থেকে সামান্য দূরত্বে থাকলেও তাঁদের এসব বিপন্নতার কথা প্রচারমাধ্যমে আসে না আজকাল। বললাম, প্রথম আলোতে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ কয়েকবার লিখেছেন এসব নিয়ে। তবে তাঁদের সঙ্গে একমত হতে হলো, প্রচারমাধ্যমে এলেও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কাছে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত অনেকখানি ভুলে যাওয়া বিষয়। খোদ ঢাকার মনোযোগেও তিস্তা নেই। 

নদী কমিশনের বৈঠক হয় না অনেক বছর

সীমান্তবর্তী নদীগুলোর পানিবণ্টনের বিষয় আলোচনার আনুষ্ঠানিক ফোরাম ‘যৌথ নদী কমিশন’ (জেআরসি)। প্রায় ৯ বছর জেআরসির উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয় না। যে স্বাক্ষরিত বিধিবলে এই কমিশন কাজ করে, তার পঞ্চম অধ্যায়ে বছরে কমিশনের চারটি বৈঠকের কথা আছে। ২০১০ সালের মার্চে সর্বশেষ ৩৭তম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয় কমিশনের।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পঞ্চাশের অধিক সীমান্ত নদী। তারপরও প্রায় ৯ বছর জেআরসির উচ্চপর্যায়ের বৈঠক না হওয়া বিস্ময়কর। উভয় দেশের সম্পর্ক ‘ইতিহাসের সর্বোত্তম পর্যায়ে’ গিয়ে জেআরসির কার্যক্রম বাড়তি গতি পাবে, সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। সম্প্রতি আভাস পাওয়া যাচ্ছে, জেআরসির উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হতে পারে। তিতাস নদে দূষিত পানি ছাড়া এবং মুহুরীর চরের জমির জরিপও এ রকম বৈঠকের জন্য অপেক্ষমাণ আলোচ্য বিষয় হয়ে আছে। তবে তিস্তার সমাধানে কী কথা হয়, সেটা নিয়েই সবার আগ্রহ।

তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের পুরো পথজুড়েই মানুষ ও প্রকৃতির অবস্থা খুবই করুণ এই মুহূর্তে। অঞ্চলের হিসাবে নদীটির অববাহিকার মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু জনসংখ্যার হিসাবে এটা অনেক বেশি। সমগ্র অববাহিকার ৫০ শতাংশ মানুষই বাংলাদেশের। অথচ শুষ্ক মৌসুমে ১ হাজার কিউসেক পানিও মেলে না অনেক সময়। এ কারণে বৃহত্তর রংপুরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নামছে। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের আগে শুকনো মৌসুমে ভাটিতে ৫ থেকে ৮ হাজার কিউসেক (কিউসেক = প্রতি সেকেন্ডে ১ ঘনফুট) পানি আসত বলে এলাকার লোকজনের দাবি। গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শুকনো মৌসুমে একপর্যায়ে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ কিউসেক পানি আসছে। অথচ সেচ বাদ দিয়ে কেবল নদীটির স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্যের জন্যও তিস্তায় ৩ থেকে ৪ হাজার কিউসেক প্রবাহ থাকা দরকার। পানিবণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি না থাকায় উজানে পানি প্রত্যাহারের অবাধ সুযোগ থাকে। কেবল এ কারণেই নদী ও মানুষের এই দুরবস্থা চলছে বলে স্থানীয় লোকজনের মত।

বাংলাদেশের প্রবাসী ভূতত্ত্ববিদ মো. খালেকুজ্জামানের মতে, ভারত যেভাবে তিস্তা প্রকল্পে সেচের আওতা বাড়াচ্ছে, তাতে কোনো চুক্তিতে না আসাই তার জন্য লাভজনক। এখন যেভাবে তারা পানি প্রত্যাহার করছে—চুক্তি হলে সেখান থেকে সরে আসতে হবে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ম ইনামুল হক মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘প্রয়োজনীয়’ পানি রেখেও বাংলাদেশ অন্তত ৩ হাজার কিউসেক পানি পেতে পারে। ‘জনগণের তরফ থেকে চাপ না থাকা’কে তিস্তার পানি না পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর মতে, তিস্তা চুক্তি না হওয়া এবং যৌথ নদী কমিশনের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক না হওয়া বড় এক ক্ষতি।

নদী রক্ষা আন্দোলনের একজন জাতীয় সংগঠক আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম মনে করেন, তিস্তাসহ সব নদীর হিস্যার প্রশ্নে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় ভরসা জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি। ভাটির দেশগুলোর আশার আলোরূপী এই কনভেনশন ৩৫ দেশের অনুস্বাক্ষরে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আইনে রূপ নিলেও তার প্রতি বাংলাদেশের অনাগ্রহ বিস্ময়কর। 

১২ উপজেলায় চাষিদের ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে বরাবর বলা হচ্ছে, মূলত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তিতে তিস্তা নিয়ে ২০১১ সালে প্রায় চূড়ান্ত হওয়া চুক্তিটি আটকে আছে। এই বক্তব্যকে প্রশ্নসাপেক্ষ মনে করেন মো. খালেকুজ্জামান। বর্তমান লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পানিসম্পদ যদি তাদের প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হতো, তাহলে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প সরকার হাতে নিতে পারত না। এটা নিয়ে প্রাদেশিক ও স্থানীয় পর্যায়ে আপত্তি ছিল। তাঁর এ–ও দাবি, পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা প্রকল্পটি কেন্দ্রীয় অনুদানপ্রাপ্ত ‘জাতীয় প্রকল্প’। সেখানে সেচের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তিস্তার পানিকে বিবেচনায় নিয়েই। সেচের আওতা বাড়ানো ছাড়াও তিস্তার সিকিম অংশে কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে এবং আরও হবে। কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া এসব হওয়ার নয়। তিস্তার প্রবাহসংকটের বড় কারণ ওই সব প্রকল্পও।

কিন্তু বিপরীতে, তিস্তার প্রবাহের মুমূর্ষু দশা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা প্রায় অনুপস্থিত। সর্বশেষ কয়েকটি বাম দল ২০১৫-১৬ সালে তিস্তাপারের মানুষের পানি হিস্যার দাবিতে কিছু কর্মসূচি পালন করে। সে সময় বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা ঢাকায় এক কনভেনশনে নিজস্ব তদন্তের ফল তুলে ধরে জানিয়েছিল, কেবল এক মৌসুমে পানির ন্যায্য অংশ না পেয়ে তিস্তা অববাহিকার ১২টি উপজেলায় চাষিদের ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। উপরিউক্ত হিসাবকে আমলে নিলে তিস্তা অববাহিকার চাষিদের প্রতি দশকে ক্ষতি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। বহুকাল হলো এই বিপন্নতা চলছে এবং রংপুরের চাষিরা শ্যালো ইঞ্জিনচালিত সেচযন্ত্র বসানোর জন্য গর্তের গভীরতা বাড়িয়ে চলেছেন।

তবে মো. খালেকুজ্জামান মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিস্তা বিষয়ে নাটকীয় কিছু হবে না। তাঁর মতে, তিস্তা প্রশ্ন আমাদের শক্তিশালী দাবি আকারে নেই আর। এই পরিস্থিতিতে বরং পানি ব্যবস্থাপনাগত কিছু ব্যবহারিক কৌশলের প্রস্তাব করেন তিনি। যার মধ্যে আছে পানি ব্যবহারে অপচয় কমানো, বিকল্প পানির উৎস সন্ধান, বেশি পানি-নির্ভরশীল শস্য উৎপাদন কমিয়ে বিকল্প শস্য উৎপাদন, জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি অনুস্বাক্ষর এবং অববাহিকার অন্যান্য দেশকেও তা গ্রহণে উৎসাহিত করা।

এসব পরামর্শ নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু তিস্তাপারের মানুষের সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, ২০১১ সালের পর হঠাৎ কেন তিস্তার পানিতে এত টান পড়ল? ২০১১ সালেও ৩ থেকে ৫ হাজার কিউসেক পানি আসত। আগে আরও বেশি ছিল। হঠাৎ পানি উধাও হলো কেন? 

আলতাফ পারভেজ, গবেষক