মানসম্মত শিক্ষা ও বলির পাঁঠা

গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর ‘সংখ্যা নয়, অগ্রাধিকার হোক শিক্ষার মানে’ প্রতিবেদনে প্রায় সব পক্ষই স্বীকার করেছে, আমাদের শিক্ষার মান অনেকখানি পড়ে গেছে এবং সম্ভবত এটি ক্রমাগত নিম্নমুখী।

বিশ্বব্যাপী জাতিগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনে রেখে নতুন প্রজন্মকে তৈরি করার মিশনে নেমেছে। ধারণা করা হচ্ছে, স্বয়ংক্রিয়তা, রোবট, ইন্টারনেট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—এসব কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ বর্তমান ৮০ কোটি কাজ বিলুপ্ত হয়ে যাবে! এগুলোর বেশির ভাগই করে কম আয়ের দেশের মানুষ। কারণ, এসব কাজের বেশির ভাগই শ্রমনির্ভর। এগুলোর বড় অংশই তখন রোবটরা করে ফেলবে। অন্যদিকে, নতুন ১০০ কোটি কাজও কিন্তু সৃষ্টি হবে। তবে, সেগুলোতে শ্রমের চেয়ে মেধার প্রাবল্য থাকবে বেশি। বিষয়টি মাথায় রেখে বিশ্বব্যাপী জাতিগুলো তাদের শিক্ষাকে ঢেলে সাজাচ্ছে। এবারের বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের বিষয়বস্তুও তা-ই। কারণ শিক্ষাই এখন বিনিয়োগের মূল জায়গা। নতুন কাজের বড় অংশজুড়ে যেহেতু থাকবে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং, প্রবলেম সলভিং, কমিউনিকেশন দক্ষতা, তাই শিক্ষাকেও বের করা হচ্ছে মুখস্থ, গতানুগতিক প্রশ্ন-উত্তরের কবল থেকে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন ধরা হয় বিশ্বের সেরা শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে ১৮ বছর পর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষাই নেই!

|এখানে দিন দিন পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ে বহুনির্বাচনী পরীক্ষা তুলে দেওয়ার কথা ভাবা হয়, বন্ধ করে দিতে চাওয়া হয় কোচিং সেন্টার। আরও কত কিছুর দায়ে যে আরও কত কিছু এখানে বন্ধ করে দিতে চাওয়া হবে, কে জানে। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে অনেকের রোষ আপাতত কোচিং সেন্টারের ওপর, বিশ্বব্যাপী যে জিনিসটি ‘শ্যাডো এডুকেশন’ বা ‘ছায়া শিক্ষা’ হিসেবে পরিচিত।

ছেলে-মেয়েদের স্কুল ভালো লাগে না, তাদের ভালো লাগে কোচিং সেন্টার। শিক্ষকেরাও নাকি কোচিংয়ে পড়াবেন বলে ক্লাসে পরিপূর্ণ পাঠ দেন না। কথাটা একেবারে ভুল নয়। সে জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী পড়াতে পারবেন না, এই নিয়ম পর্যন্তই ঠিক ছিল। কিন্তু সেটার ধাক্কা এখন পুরো ছায়া শিক্ষার ওপর এসে পড়েছে। অনেকেই হয়তো মনে করছেন, ছায়া শিক্ষার অস্তিত্ব না থাকলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা রাতারাতি বিশ্বের বুকে একটা রোল মডেল হয়ে দাঁড়াবে!‍

কিন্তু আমরা খতিয়ে দেখছি না কেন কোচিং সেন্টারগুলো আছে। এটার মূল কারণই হলো আমাদের চরম প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা। এটির কোনো বিকল্প তো আমাদের নেইও। সে কারণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেরা মেধাবী ছাত্রটিকে খুঁজে বেড়ায়, যে কিনা হাজারের মধ্যে এক। আর যত দিন আপনি এই এককে খুঁজবেন, তত দিন ছায়া শিক্ষা মোটামুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। এ শুধু বাংলাদেশে নয়। চীন, জাপান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া কোনোটিই শিক্ষায় পিছিয়ে নেই, কিন্তু এদের শিক্ষাব্যবস্থা অতি প্রতিযোগিতাপূর্ণ। এসব দেশে কিন্তু ছায়া শিক্ষার প্রাবল্য ব্যাপক। যেগুলোকে আমরা কোচিং সেন্টার বলি, সেগুলোকে জাপানে বলা হয় জুকু। এ রকম সেন্টার আছে ওদের ৫০ হাজার (দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এবং জাপান টাইমস-এর তথ্যানুযায়ী) এবং এর বাজারমূল্য ১০ ট্রিলিয়ন ইয়েন (দ্য জাপান টাইমস)। এদের রয়েছে গোটা বিশেক চেইন কোচিং ইনস্টিটিউট। সবচেয়ে বিখ্যাতটির নাম কুমন এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট, যা অতি সম্প্রতি বাংলাদেশেও তাদের শাখা খুলেছে! সেখানে বছরে ১৫ লাখ ছেলে-মেয়ে পাঠ সহায়তা নিচ্ছে। একটি পুরোনো সরকারি জরিপে দেখা যাচ্ছে, এ রকম সেন্টারে পড়ুয়াদের হার মিডল স্কুলে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন সেন্টার আছে ৭০ হাজার আর প্রায় ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই কোচিং করে (উইকি-এর তথ্য অনুযায়ী)। সিঙ্গাপুরে প্রাইমারি শিক্ষার্থীদের ৮০ শতাংশ আর হাইস্কুলের ৬০ শতাংশ ছেলেমেয়েই কোচিং নিচ্ছে! (PISA-Programme for International Student Assessment-এর তথ্যানুযায়ী) সেসব দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বা মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে এসব সেন্টারকে কেউ সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখছেন না। বরং এদের ছায়া শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আনা হয়েছে নিয়মের মধ্যে। তাঁরা মনে করছেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি কোচিংয়ে গিয়ে পূর্ণ পাঠ লাভ করতে পারে, যদি কোনো উৎকর্ষ অর্জন করতে পারে, তাহলে ক্ষতি কী? সেখানে তাই কোচিং সেন্টারগুলোও তেমনই। সেগুলো সরকারের আওতায় থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করছে।

এসব দেশে কিন্তু শ্রেণিকক্ষে আমাদের দেশের মতো ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থী থাকে না। ওদের গড় ক্লাসের আকার ১৫-২০ জন। তার মানে শিক্ষক প্রায় সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে দেখাশোনা করতে পারেন। তাহলে তাদের দেশে কেন লোকে ছেলে-মেয়েদের কোচিং সেন্টারে পাঠাচ্ছে? উত্তরটা সহজ। প্রতিযোগিতার জন্য অধিকতর যোগ্যতা অর্জন করা।

আমাদের দেশে কিন্তু মূল শিখনফল অর্জন করানোই শিক্ষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে কারিকুলামে নির্দেশিত শিখনফল অর্জনে তাঁদের দায়বদ্ধতা না থাকা যেমন দায়ী, তেমন দায়ী শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকা। পাশাপাশি দায়ী হলো সহজে ম্যানেজ করা যায় না এমন ক্লাসরুম, শেখানোর চেয়ে পরীক্ষা নেওয়ার চাপ ইত্যাদি। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জাতীয় অভীক্ষা হচ্ছে সেই ২০০৬ সাল থেকে। প্রতি দুই বছর পর পর দেখা হয় তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান। এই অভীক্ষার সর্বশেষটি (২০১৫) অনুসারে ৫ম শ্রেণির মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন করতে পারে। অথচ অনেক সরকারি প্রাথমিক স্কুলে অমানবিকভাবে শিক্ষার্থীদের সকাল ৯.৩০ থেকে বিকেল ৪.১৫ মিনিট পর্যন্ত ‘পড়ানো’ হয়!

মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনেক কাজ করতে হবে। সে জন্য মূল ব্যাপারগুলো ঠিকভাবে বোঝাটা দরকার। অহেতুক ভিন্ন ও একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে শক্তি ও সামর্থ্য ক্ষয় করার কোনো দরকার নেই। জরুরি কাজগুলোই জরুরিভাবে করা দরকার।

মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক