পুলিশ সপ্তাহ

প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে পুলিশ সপ্তাহ পালিত হলেও ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে এবার সেটি ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে হলো। সময়টি মুখ্য নয়, মুখ্য হলো সেই পুলিশ সপ্তাহ থেকে কী কী অর্জিত হলো। সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে, তাতে অপরাধ দমনে পুলিশ 

বিভাগের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। বরং পুলিশ সপ্তাহে যাঁদের পুরস্কৃত করা হয়েছে, তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের নিগ্রহের অভিযোগ আছে। কথিত রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণামূলক সাক্ষাৎকার প্রচারণাকারীর গ্রেপ্তারকেও পেশাগত কৃতিত্ব হিসেবে দেখা হয়েছে। যদিও এখনো মামলাটি বিচারাধীন।

সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষ দ্বারা রাজপথে কোনো আন্দোলন হয়নি। ফলে আইনশৃঙ্খলাজনিত কোনো সমস্যা হলে তার জন্য রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে দায়ী করা যৌক্তিক নয়। কিন্তু তরুণদের কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে রাজনৈতিক রং চড়ানোর জোর প্রয়াস ছিল। সরকার তরুণদের দাবি মেনে নিয়ে দুটো আন্দোলনের যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিয়েছে। তাই এই আন্দোলনকে ঘিরে যদি কোনো অঘটন হয়ে থাকে, তার জন্য তরুণদের দায়ী করা যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতি উৎসাহী সদস্য ও সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির নেতা–কর্মীরাই পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করেছিলেন। বেশির ভাগ অঘটনের মূলে ছিলেন ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর সদস্যরা। সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পাকড়াও করলেও হেলমেট বাহিনীর টিকিটিও স্পর্শ করেনি। হ্যাঁ, পুলিশ যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় হেলমেট বাহিনীর সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনতে পারত, সেটিকে তাদের কৃতিত্ব হিসেবে ধরে নেওয়া যেত। বাস্তবে সে রকম কিছু ঘটেনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুলিশ সদস্যদের প্রতি নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ যাতে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এই আহ্বান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে ক্ষমতাধরদের প্রভাব কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তার ভুলের কারণে নিরীহ মানুষ হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন। এর পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি করা হয়েছে, যা আলোচনার দাবি রাখে। এসব দাবির মধ্যে যৌক্তিক কিছু নেই সে কথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যেমন সার্ক দেশগুলোর সঙ্গে সমতা রেখে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো, অপরাধী ধরার সময় আহত পুলিশ সদস্য ও নিহত পুলিশ সদস্যের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো, চিকিৎসাসেবার সুযোগ বাড়ানো। পুলিশ বাহিনীর লোকবল বাড়ানোর পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে আনুষঙ্গিক সুযোগ–সুবিধাও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি।

কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য জমি বরাদ্দ এবং তাঁদের আজীবন রেশন সুবিধা পাওয়ার দাবি কতটা বাস্তবসম্মত, তা ভেবে দেখার বিষয়। কোনো একটি বিভাগের কর্মকর্তাদের জমি বরাদ্দ দেওয়া হলে অন্য বিভাগের কর্মকর্তারাও একই আবদার তুলবেন। আজীবন রেশন পাওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

এ ধরনের আয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাফল্য–ব্যর্থতার মূল্যায়ন হওয়া জরুরি বলে মনে করি। অপরাধ দমনে পুলিশের ব্যর্থতা ও দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তার ওপরই এই বাহিনীর সাফল্য নির্ভর করছে। প্রতিবছরই পুলিশ সপ্তাহ পালিত হয়ে থাকে। তাদের এই উদ্‌যাপন তখনই সার্থক হবে, যখন পূর্ববর্তী পুলিশ সপ্তাহ থেকে পরবর্তী পুলিশ সপ্তাহে অপরাধের হার ও মাত্রা কমার সুসংবাদ মিলবে। তার আগ পর্যন্ত এটি নিছক আনুষ্ঠানিকতা হয়েই থাকবে।