বঙ্গবন্ধু শোনাচ্ছেন হাসির গল্প

শেখ মুজিব বললেন, ‘সিংহ, বাঘ আর পাতিশিয়ালের গল্পটা শুনেছিস তো? এক ছিল বন। সেই বনে থাকে এক বাঘ, এক সিংহ আর এক পাতিশিয়াল। তিনজনে মিলেমিশে থাকে। একদিন তিনজন মিলেই শিকার করে আনল একটা মোষ, একটা গরু আর একটা হরিণ।

শিকার শেষে বনের রাজা সিংহ তার প্রধান সহযোগী বাঘকে বলল, বাঘ মিয়া, বলো, এই তিনটা শিকার আমরা কীভাবে ভাগ করে নেব।

বাঘ বলল, আপনি পশুরাজ, আপনি নেবেন মোষটা, আমি বাঘ, আমি নেব গরুটা, আর শিয়াল নেবে হরিণটা।

সঙ্গে সঙ্গে সিংহ রেগে গেল। এক থাবা বসাল বাঘের ঘাড়ে। পাজি কোথাকার, এই তোর বিচার। সেই থাবায় বাঘ চিতপটাং। আর উঠতে পারে না।

এবার সিংহ শিয়ালকে বলল, বলো কীভাবে ভাগ করা হবে?

শিয়াল বলল, মোষটা হুজুর দুপুরে খাবেন, রাতে খাবেন গরুটা, আর কাল সকালের নাশতায় খাবেন হরিণটা। ভাগ খতম।

শুনে সিংহ বেজায় খুশি। তিনি পাতিশিয়ালকে কাছে ডেকে আদর করে বললেন, তুমি তো খুব সুন্দর ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে পারো। কোথা থেকে শিখলে এই সুন্দর বণ্টনরীতি!

শিয়াল বলল, হুজুর, এই বণ্টনরীতি শিখতে আমাকে বেশি দূর যেতে হয়নি। ওই যে আমাদের সামনে পড়ে আছে বাঘ, তার দুরবস্থা দেখেই এই বণ্টনরীতি আমি শিখে ফেলেছি।’ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। শেখ মুজিব গল্প করছেন শাহ মোয়াজ্জেম ও অন্য সহবন্দীদের সঙ্গে।

এরই মধ্যে তাঁর চারপাশে আরও শ্রোতা এসে ভিড় করেছেন। তাঁরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন।

শেখ মুজিব বললেন, ‘তোদের ওই মোনেম খানও বণ্টনরীতি ঠিকঠাক শিখে ফেলেছেন। তিনি জানেন, সবকিছু করতে হবে আইয়ুব খানের নামে। তাই তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।’

শাহ মোয়াজ্জেম বললেন, ‘আচ্ছা মুজিব ভাই, বিরোধী দলের অনেক দাবি তো থাকে ন্যায্য। সেসব মেনে নিলেই তো রাষ্ট্রের উপকার হবে। সরকারের ক্ষতি কম হবে। জনগণের উপকার বেশি হবে। সেসব না মেনে সেই দাবি স্তব্ধ করতে কেন আয়োজন। এত ষড়যন্ত্র। কেন এত স্টিমরোলার?’

মুজিব বললেন, ‘তুই ঠিক বলেছিস। আমাদের দাবি মেনে নিলে জনগণের উপকার হবে। রাষ্ট্রের ক্ষতি কম হবে। তাই তো আমি সব সময় বলি, দাবি মেনে নাও। আমরা আর সংগ্রামের পথে যাব না। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনে না। ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে। ক্ষমতা মানুষকে সন্দেহপ্রবণ করে। ক্ষমতাসীনেরা সব সময় ক্ষমতা হারানোর ভয়ে থাকে। তারা মনে করে, চারদিকে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে সব সময়। পশ্চিমারা দাবি মানতে দেরি করে ফেলছে। যখন দাবি মানবে, তখন জনগণ আরও এগিয়ে যাবে। ওই দাবি মানলেও তখন জনগণকে আর সন্তুষ্ট রাখা যাবে না। এটা ওরা বুঝছে না। ওদের অবস্থা হবে সেই উজানীর বউটার মতো!’

শাহ মোয়াজ্জেম আবারও গল্পের সন্ধান পেলেন। ‘মুজিব ভাই, উজানীর বউয়ের গল্পটা কী। ওটা শোনান।’

শেখ মুজিবকেও যেন গল্পে পেয়েছে। তিনি বলতে লাগলেন, ‘এটা মিজান চৌধুরীর গল্প। ওর মুখে শুনলে তোরা বেশি মজা পেতি। এক বউ সব সময় উল্টো পথে চলে। স্বামী যা বলবে, শাশুড়ি যা বলবে, সে ঠিক তার উল্টো কাজটা করবে। ডানে যেতে বললে যাবে বামে। উত্তরে যেতে বললে যাবে দক্ষিণে। কিছুতেই সে কথা শুনবে না। একদিন বউটা নদীতে পানিতে ডুবে মরে গেল।

তখন তার মৃতদেহ খোঁজার কাজ চলছে। স্বামী লাশ খোঁজে। আরও লোক এসে জুটল। মাঝিমাল্লা, জেলেরা এসে নদীতে জাল ফেলতে লাগল।

স্বামী বলল, এইখানে সে নদীতে পড়েছে, তার লাশটা খুঁজতে হবে উজানে।

সবাই বলল, তা কী করে হয়? লাশ তো যাবে ভাটিতে।

স্বামী বলল, আমার বউ। আমি জানি। সে কোনো দিনও সোজাপথে চলে নাই। উল্টো পথে চলেছে। সবার লাশ ভাটিতে যাওয়ার কথা, আমার বউয়ের লাশ যাবে উজানে।

সবাই উজানে লাশ খুঁজতে লাগল। পাওয়া গেল না। শেষে ভাটিতে খোঁজা শুরু হলো। দেখা গেল, লাশ স্রোতে ভেসে বেশ নিচের দিকে চলে গেছে। লাশ পাওয়া গেল।

তখন স্বামী বেচারা ডুকরে কেঁদে উঠে বিলাপ করে বলতে লাগল, হায় রে উজানী, সেই তো ভাটিতেই গেলি! শুধু বেঁচে থাকতে গেলি না।’

শাসকদেরও একদিন চৈতন্যোদয় হবে। তারাও একদিন ভাটিতে যাবে। আমাদের কথা শুনবে। শুধু বেঁচে থাকতে যাবে না। যখন যাবে, তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রটা আর বেঁচে থাকবে না।

আমার সদ্য প্রকাশিত এই পথে আলো জ্বেলে বই থেকে এই অংশ তুলে দিলাম। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি পেশ করার পর তাঁকে জেলে নেওয়া হয়। তখন তিনি জেলসঙ্গীদের এই দুটি গল্প বলেছিলেন। এই অংশের উৎস শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বই নিত্য কারাগারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা, কাজ, আদেশ-নিষেধ কিন্তু আমাদের জন্য চিরদিনের প্রেরণা। কারাগারের রোজনামচা আর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি যে উপলব্ধির কথা লিখে গেছেন, তা-ই আমাদের পথ দেখাতে পারে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে।

কারাগারের রোজনামচা বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তিনটা কাগজের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছে। একটা সংবাদ, পূর্ব পাকিস্তানের কাগজ, আর দুইটা নওয়াই ওয়াক্ত ও কোহিস্তান—পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজ। প্রায় সব কাগজকেই সরকার ছলেবলে-কৌশলে নিজের সমর্থক করে নিয়েছে। যে দু-চারটা কাগজ এখনো নিরপেক্ষতা বজায় রেখে জনগণের দাবিদাওয়া তুলে ধরছে, তাদের শেষ করার পন্থা অবলম্বন করেছে সরকার।’

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘দেশকে ধ্বংসের দিকে এরা নিয়ে চলেছে। ফলাফল ভয়াবহ হবে।’

কিংবা বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ আমাদের চিরদিন প্রেরণা দেবে: ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক