ক্ষতি কার হচ্ছে ভেবেছেন?

প্রতিবেশী কোনো লোক, আপন মামা, চাচা, খালু বাড়ির ছোট শিশুকে ধর্ষণ করছেন—এ ধরনের খবরের মধ্যেই এক বাবার বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। আর এ অভিযোগ করেছেন অভিযোগ ওঠা ব্যক্তির সাবেক স্ত্রী এবং মাত্র নয় বছর বয়সী মেয়েটির মা। ঘটনার পর এই মা রাজধানীর রমনা থানায় বাবার বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন। এর আগে মেয়েকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) গিয়েছেন মেয়ের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার জন্য।

গণমাধ্যম কিন্তু চুপ করে বসে নেই। কিছু কিছু গণমাধ্যমে অভিযোগ ওঠা বাবার নাম, পরিচয় ও পরিবারটির বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে এবং করছে। গত মঙ্গলবার ঘটনার পরপর বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক এই মাকে ভিডিওর সামনে এনে জানতে চেয়েছেন ঘটনাটি কীভাবে এবং কোথায় ঘটল। বারবার বলেছেন, মেয়েটির বাবার নামটা বলেন। তাঁর পরিচয়টা বলেন। এর বাইরেও পারিবারিক নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে ওই মাকে বিব্রত করেছেন। সেই ভিডিও ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে গেছে। 

ভিডিওতে এই মা প্রথম দিকে অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তবে একসময় কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। সাবেক স্বামীর নাম-পরিচয় জানতে চাইলে বলতে বাধ্য হন, ‘আপনারা এমনিতেই জেনে যাবেন।’

এই মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার জন্য নয়, আমার মেয়ের কথা চিন্তা করে ভিডিওতে মুখ দেখাইনি। কেউ যাতে আমার মেয়েকে কিছু না বলে, সে বিষয়ে সতর্ক করে দিই। ঘটনার পর একটি বেসরকারি টেলিভিশন আমাকে ফোন না দিয়ে, আমার কথা না শুনে অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিকে লাইভে এনে তাঁর কথা শোনে।’

এ তো গেল গণমাধ্যমের কথা। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একেকজন বিচারকের আসনে বসে গেছেন। ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন—এই সেই বাবা, যে তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করেছেন। এই বাবার শাস্তিও নির্ধারণ করে দিচ্ছেন কোনো কোনো স্ট্যাটাসদাতা এবং তাতে কমেন্টকারী ব্যক্তিরা।

বাবা মেয়েকে ধর্ষণ করেছেন, এ অভিযোগের পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। হয়েছেও তা-ই। ফেসবুকে যা হচ্ছে, তা সেই প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। কেননা, ঘটনাটিকে কেউ মানতে পারছেন না। কিন্তু এই অভিযুক্ত বাবার ছবি ফেসবুকে দিয়ে আসলে কি কোনো লাভ হচ্ছে? এতে করে কি এই অভিযুক্ত বাবার শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যাবে?

এই বাবার ছবি দিয়ে আমরা আসলে কার ক্ষতি করছি, তা কি চিন্তা করেছি কখনো? আমরা ক্ষতি করছি মাত্র নয় বছরের শিশুটির, যে এই বাবার সন্তান। এই বাবার পরিচিতজনেরা একবার করে মেয়েটির চেহারা মনে করছেন। মেয়েটি এই সমাজেই বড় হবে, কিন্তু সে বাবার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার, তা কিন্তু পরিচিতজনেরা ভুলতে পারবেন না। বিভিন্ন কায়দাকানুন করে মেয়েটিকে কেউ কেউ সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিতেও ভুলবেন না। এই বাবার ছবি না দিলে, ভিডিওর সামনে মাকে কাঠগড়ায় দাঁড় না করালে অন্তত কিছু মানুষ মেয়েটির পরিচয় জানতে পারতেন না। একদম কাছের লোকজন জানলেও তাঁরা কখনোই মেয়েটি বা তার মাকে আঘাত দিয়ে হয়তো কথা বলবেন না। কিন্তু স্বল্প পরিচিত ব্যক্তি এই সুযোগ নেবেন না, তা কি আমরা কেউ বলতে পারি?

এই বাবা মেয়েকে আসলেই ধর্ষণ করেছেন কি না, তা তদন্তের পর আইনের আওতায় নির্ধারিত হবে। কিন্তু ফেসবুকে একদল যেমন এই বাবার বিচার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, আরেক দল এই মায়ের চরিত্র হননে মাঠে নেমেছে।

এই মা তো স্বামীকে তালাক দিয়েছেন। এই মায়ের নামে অনেক খারাপ কথা আছে। এই মা সাবেক স্বামীকে ফাঁসানোর জন্য মেয়েকে দিয়ে ধর্ষণের নাটক সাজিয়েছেন—এ ধরনের অনেক বক্তব্যে ভরে গেছে একেকজনের ফেসবুকের ওয়াল। অনেকে সরাসরিই বলছেন, এই মা অন্য কাউকে দিয়ে মেয়েকে ধর্ষণ করিয়ে সাবেক স্বামীর নামে অভিযোগ করছেন। এই মা তো আগেও সাবেক স্বামীর নামে কয়েকটা মামলা করেছেন, তাই এবারও মামলা সাজাতে পারেন।

আচ্ছা, এই মাকে নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতাই-বা কে দিল?

এই মা প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনে শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সাবেক স্বামী মারধর করেননি। এমনকি তালাক দেওয়ার পরও পিছু ছাড়েননি। কর্মস্থলে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে সব জায়গায় গিয়ে তাঁর সাবেক স্ত্রী কতটা খারাপ, তা প্রমাণে মরিয়া ছিলেন। তালাকের পর স্বামীর এক খালাসহ অন্য আত্মীয়রা ছেলেমেয়েকে ছয় মাস মায়ের কাছ থেকে দূরে রাখেন। রাতে মেয়ে বাবার সঙ্গে ঘুমাত। ছয় মাস পর মায়ের কাছে ফিরে এলে মেয়ে একবার জানায়, তার অনেক পেটব্যথা হতো, তখন মায়ের কথা অনেক মনে হতো। পেটে ব্যথার কারণ জানতে চাইলে বাবাকে কিছু জানানো হবে না শর্তে মেয়ে জানায়, রাতে তার বাবা স্পর্শকাতর জায়গায় কিছু একটা করেন, যাতে তার ব্যথা হতো। বমিও করত।

এই মা বলেন, ‘মেয়ের মৌখিক অভিযোগের পর থানায় গিয়েছিলাম অভিযোগ করার জন্য। থানায় সাবেক স্বামীকে এনে চা খাওয়ানো হয় আমার সামনেই। তখন আর বেশি দূর আগাতে পারিনি। তবে এইবার মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে গাড়িতে আবার কিছু একটা করেছে বলে মেয়ে অভিযোগ করলে আমি আর চুপ থাকতে পারিনি। আসলে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না কোনো বাবা মেয়ের সঙ্গে খারাপ কিছু করতে পারে। তারপর থেকে থানা, পুলিশ, হাসপাতালে দৌড়াচ্ছি।’

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এ যৌন পীড়নের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে,

‘যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যেকোনো অঙ্গ বা কোনো বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করেন, তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন।’ আইনে এর শাস্তি হিসেবে বলা আছে, ‘ওই ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর বাইরে অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’

অর্থাৎ, মেয়ের আগের বা এবারের অভিযোগ সঠিক হলে এই বাবা যৌন পীড়নের দায়ে অপরাধী হবেন। হতেই পারেন। এবারই প্রথম কোনো বাবার বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, বিষয়টি তেমনও না। তবে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি, তার পরিবার, অভিযুক্তের প্রতি কিছু বলার ক্ষেত্রে, লেখার ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুনও মানা প্রয়োজন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এ সংবাদমাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধানিষেধও দেওয়া আছে।

আইনে বলা আছে, অপরাধের শিকার হয়েছেন এমন নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তত্সম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোনো সংবাদপত্রে বা অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাবে না, যাতে ওই নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায়৷ তো গণমাধ্যম বা ফেসবুকে অভিযুক্ত বাবার ছবি দেওয়ায় আমরা কি এই শিশুর পরিচয় গোপন রাখতে পারছি? গণমাধ্যমকর্মীদের কাঠগড়ায় ভিডিওর সামনে একপর্যায়ে এই মায়ের মুখেরও বেশ কিছু অংশ প্রকাশ পেয়ে যায়। গণমাধ্যম এবং ফেসবুকে অভিযুক্ত বাবার ছবি প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে কথা হয় এই মায়ের সঙ্গে। উত্তেজিত হয়ে প্রথমে এই মা বলেন, ‘ঠিকই হয়েছে, আমি চাই এই বাবাকে সবাই চিনুক। যেখানে দেখবে, সেখানেই যাতে মেরে ফেলে।’ তবে অনেকক্ষণ কথা বলার পর একপর্যায়ে এই মা-ও স্বীকার করলেন অভিযুক্ত বাবার ছবি প্রকাশ করা ঠিক হচ্ছে না। মেয়েটি চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভ এবং কান্নার রেশ টেনে বললেন, ‘আমার মেয়ে তো এই সমাজেই বড় হবে।’

বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত টেলিফোনে এই মায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়। রাত সাড়ে আটটার দিকে এই মা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাকে দুপুর থেকে থানায় এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আইও এলে আমাকে নিয়ে আসামি ধরতে যাবে। রাত সাড়ে আটটা বাজে, এখন পর্যন্ত আইও নাকি আসেননি। ওসি নেই বলা হলেও দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম তিনি টেলিফোনে হেসে হেসে কথা বলছেন। এখন গণমাধ্যম কোথায়?’

লেখক: সাংবাদিক