বেকার তরুণ সমাজ

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রতিবেদনে তরুণদের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা হতাশাব্যঞ্জক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণীর অবস্থা এমন যে কাজেও নেই, আবার পড়াশোনাও করেন না। এক বছর আগে এই শ্রেণির তরুণের হার ছিল ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে পড়াশোনা বা কাজ না করা তরুণের হার বেড়ে গেছে দুই শতাংশের বেশি। অর্থনীতির অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশ যত এগিয়ে থাক না কেন, উন্নয়ন–প্রক্রিয়ায় সব তরুণকে যুক্ত করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন অলীক কল্পনা হয়েই থাকবে।

এ ধরনের প্রতিবেদন বেসরকারি বা বিদেশি সংস্থা প্রণয়ন করলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তারস্বরে প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু এটি তৈরি করেছে
খোদ বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, প্রায় শতভাগ শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে;
অর্থনীতির আকার বাড়ছে—এগুলো নিঃসন্দেহে সরকারের সাফল্য। কিন্তু শিক্ষিত তরুণ–তরুণীদের কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সরকারের সুচিন্তিত কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থা বিন্যস্তই করা হয় দেশের শ্রমশক্তির চাহিদা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাব্য সুযোগের কথা ভেবে।

দেশি-বিদেশি সব জরিপই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বেশি। এর অর্থ হলো রাষ্ট্র তরুণ–তরুণীদের উচ্চশিক্ষা দিয়েও কাজে লাগাতে পারছে না। অথচ তাঁদের পেছনে শুধু পরিবারের নয়, রাষ্ট্রেরও বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, এ সমস্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় চলেছি তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সরকার মুখে বলে তারুণ্যই শক্তি। কিন্তু অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাঁদের স্থান নেই। এভাবে আমাদের টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কত দিন সম্ভব?

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে তরুণ সমাজের বেকারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এক বছরে বেকারত্বের হার আরও বেড়েছে। এই যে দেশে মাদক সেবনসহ নানা রকম অপরাধমূলক তৎপরতা বেড়ে চলেছে, তার পেছনেও অংশত কাজ করছে বেকারত্ব। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে ২০২০ সালের মধ্যে কাজ ও পড়াশোনা কোনোটিই করেন না, এমন তরুণ-তরুণীর হার ২২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। হাতে আছে মাত্র দুই বছর। এই সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কীভাবে সম্ভব?

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তরুণ সমাজের বেকারত্বকে দেশের অন্যতম বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। বিপুলসংখ্যক তরুণ–তরুণীকে কাজে লাগাতে হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সে জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন, কিন্তু কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রায় থেমে আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ও অবকাঠামোগত যেসব বাধা আছে, সেগুলো অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে।

উদ্বেগের বিষয় হলো সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৯ লাখ কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা নিলেও কাজ দিতে পেরেছে মাত্র ১৭ লাখ। লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কম পূরণ করে কীভাবে অধিক সংখ্যক তরুণ-তরুণীকে কাজে লাগানো যাবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা মনে করি, সরকারের পুরো পরিকল্পনাই ঢেলে সাজাতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় তরুণদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে; যাতে কোনো তরুণকে অলস বসে থাকতে না হয়।