ধর্ষকদের হত্যা করে কি সমাধান আসবে?

সম্প্রতি সাভার ও ঝালকাঠিতে দুজন কথিত ধর্ষকের লাশ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ দুজন কথিত ধর্ষককে কে বা কারা হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ডের খবর শুনলে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত হই। দুজন কথিত ধর্ষকের লাশপ্রাপ্তির খবরে আমরা উল্লসিত হতে পারিনি। অনেক অনেক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এ দুটি হত্যাকাণ্ড মামুলি খবরই বটে! নরহত্যার এ খবর দুটিও হারিয়ে যেতে পারত অন্য অনেক খবরের ভিড়ে। কিন্তু সেটি হয়নি। কারণ, দুটি লাশের সঙ্গেই চিরকুট পাওয়া গেছে। আশুলিয়ায় নিহত রিপনের লাশের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি ধর্ষণ মামলার মূল হোতা।’ অন্যদিকে, ঝালকাঠিতে নিহত সজলের লাশের সঙ্গে থাকা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার নাম সজল। আমি রহিমার (ছদ্মনাম) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’

ঢাকার আশুলিয়ায় এক কিশোরী ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি রিপনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এটি ছিল গত ১৭ জানুয়ারির ঘটনা। এর ৯ দিন পর ২৬ জানুয়ারি পুলিশ ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলা থেকে সজল জমাদ্দার নামের এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে। তিনি পাশের জেলা পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আসামি ছিলেন। রিপনের পরিবারের দাবি, সাদাপোশাকধারী কয়েকজন ব্যক্তি গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে যান। গোয়েন্দা পুলিশ এ দাবি অস্বীকার করেছে।

রিপনের ব্যাপারে উত্থাপিত অভিযোগটি হচ্ছে, গত ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কারখানা ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় রহিম, শিপন, রিপনসহ পাঁচ বখাটে এক নারীর গতিরোধ করেন। এরপর তাঁরা ওই নারীকে ধর্ষণ করেন। এর এক দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারী মৃত্যুবরণ করলে ৭ জানুয়ারি রিপনের নামে মামলা করা হয়।

ঝালকাঠিতে নিহত সজল সম্পর্কিত ঘটনাটি হচ্ছে, গত ১২ জানুয়ারি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় এক মাদ্রাসাছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। নিজ বাড়ি থেকে নানাবাড়ি যাওয়ার পথে ওই ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এ অভিযোগে সজলকে প্রধান আসামি করে গত ১৪ জানুয়ারি ভান্ডারিয়া থানায় মামলা হলে সজল ঢাকায় পালিয়ে আসেন। এরপর মধ্য বাড্ডায় শ্বশুরের বাসায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ১৫ জানুয়ারি রাকিব নামের এক ব্যক্তি তাঁকে ডেকে নিয়ে যান, পরে ঝালকাঠিতে তাঁর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়।

যেহেতু পুলিশ রিপন ও সজলের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে, সেহেতু দুটি ঘটনাই হত্যাকাণ্ডের। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে বা কারা তাঁদের হত্যা করল? হত্যাকারীরা কেন দুটি লাশের সঙ্গেই চিরকুট রেখে গেল, যে চিরকুটগুলোর ভাষা একই রকম এবং তাতে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। বার্তাটি হচ্ছে, ধর্ষণ করলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে পড়তে হবে বা গুলিবিদ্ধ লাশ হতে হবে। অতএব নারীর সম্ভ্রমহানি তো দূরের কথা, ধর্ষণের চিন্তা মাথায়ও আনবে না। বার্তাটি যদি পুরো সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, বিশেষ করে যেসব বিকৃত রুচির পুরুষ নারীদের এ ধরনের বিপদের মধ্যে ফেলে, তারা যদি সাবধান হয়ে যায় এবং ধর্ষণের মতো পাশবিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে, তাহলে সমাজের এক বড় উপকার হয় বলেই অনেকের বিশ্বাস। মুশকিল হচ্ছে, এভাবে কি সমস্যার সমাধান হবে? তালিকাবদ্ধ হাজারো সন্ত্রাসীকে ‘ক্রসফায়ারে’ শেষ করে দিয়ে অপরাধ কি কমানো গেছে? মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে ড্রাগসের কয়েক শ চুনোপুঁটি কারবারিকে হত্যা করে এর ভয়াবহতা কতটুকু হ্রাস করা গেছে বা যাবে?

সমস্যাটির অনেক জটিল গ্রন্থি আছে এবং এটি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধু আইন ও বিচারব্যবস্থা ঠিক হলেই ধর্ষণ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটি মনে করারও কারণ নেই। সমাজের মধ্যে অনেক বাচ্চা ছেলে ও মেয়ে তাদের খুব কাছের আত্মীয়স্বজন বা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়, যে কথা তারা কোনো দিন বলতে পারে না। আর বিভিন্ন বয়সের নারীরা যে ধর্ষণের শিকার হন, তাঁদেরও অনেকে সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে ঘটনা আড়াল করে রাখেন, অনেকে পুলিশ-উকিল ও বিচারালয়ের হয়রানির ভয়ে মামলা-মোকদ্দমার দিকে যান না। তারপরও যেসব নারী সাহস করে মামলা করেন, তাঁদের মধ্যে বিচার পান গুটিকয়েক নারী। ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ধর্ষণের মামলাগুলোয় প্রতি হাজারে শাস্তি হয় চারজন ধর্ষকের। পুলিশ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার ধর্ষণবিষয়ক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ধর্ষণ মামলার ‘কনভিকশন রেট’ ৩ থেকে ৫ শতাংশের বেশি নয়।

ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের জন্য হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর যৌন পীড়নের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার মধ্যে ওই সময় পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৭টি মামলা। সাজা হয়েছিল মাত্র ১১০টি মামলায়। অর্থাৎ, বিচার হয়েছিল ৩ শতাংশের কম ক্ষেত্রে। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছেন, নয়তো পরে খালাস হয়ে গেছেন। 

প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্য, পুলিশের গাফিলতি, বিচারব্যবস্থার দুর্বলতাসহ নানা কারণে যেহেতু ৯৭ শতাংশের অধিক ধর্ষক শাস্তি পাচ্ছে না, সেহেতু ধর্ষণ মামলার আসামিদের বা কথিত ধর্ষকদের গুলি করে হত্যা করলে ধর্ষণের ঘটনা থেমে যাবে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। আবার অধিকাংশ মামলায় যদি ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে ঘটনার শিকার নারীরা যেমন মামলা করতে উত্সাহী হবেন না, তেমনি বৃদ্ধি পাবে ধর্ষকদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কা ও তার জনপ্রিয়তা।

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হয়, পুলিশ, মেডিকেল টেস্ট, পাবলিক প্রসিকিউশন–ব্যবস্থা, আদালতসহ পুরো ফৌজদারি ন্যায়বিচার-ব্যবস্থাকে যেমন নারীবান্ধব করতে হবে, তেমনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আরও কিছু পদক্ষেপ সমাজ ও রাষ্ট্রের উপকারে আসবে বলে মনে করি। এক. কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন বা যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল ছবি বা ভিডিও নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই. কোনো নারী যদি কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন, তাহলে ওই পুরুষকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নির্দোষ। যদি কোনো নারী কোনো পুরুষকে হয়রানি করার জন্য এমন অভিযোগ আনেন, তাহলে তাঁকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তিন. পরিবার, বিদ্যালয়, ধর্ম ও সংস্কৃতির সর্বত্র মূল্যবোধের এমন শিক্ষা দিতে হবে, যাতে ছোটবেলা থেকে প্রত্যেক ব্যক্তি নারীদের সম্মান ও সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক থাকেন।

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অপরাধ বিশ্লেষক