বিশ্বায়নের দুর্দিনে দায়ী কে?

প্রতীকী ছবি। অলংকরণ: সানজিদ মাহমুদ
প্রতীকী ছবি। অলংকরণ: সানজিদ মাহমুদ
>তিন দশক ধরে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা বিশ্বায়নের চাকায় এখন যেন অনেকটাই ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। বিশ্বায়িত বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন সূচকে একটা মন্দার আভাস বেশ প্রকট হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের সুদিন কি তবে শেষ হয়ে এল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এই লেখায়। আজ প্রকাশিত হলো এর শেষ পর্ব।

পশ্চিমা কিছু গবেষণায় বৈশ্বিক বাণিজ্যের ধীরগতির জন্য চীনা নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক বাণিজ্যের ধীরগতি বিশ্বায়নের চাকাকেও ‘স্লো’ করে দিচ্ছে, দেখা দিচ্ছে স্লোবালাইজেশন। কিন্তু বিশ্বায়নের সুদিন ফিকে হওয়ার হিসাবটি এত সরল নয়।

পুঁজির কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায় থেকে যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বায়ন তত্ত্বকে পেলে-পুষে বড় করেছে, তা নিয়ে শুরু থেকেই নানা বিতর্ক ছিল। বিশেষত ছোট অর্থনীতির দেশগুলোয় বিশ্বায়নবিরোধী একটি অংশ বরাবরই সক্রিয় ছিল। তাদের মূল বক্তব্য ছিল—বিশ্বায়ন যে মুক্ত বিশ্বের কথা বলে, তা আদতে একটি ভাঁওতা। শ্রমকে যথাসম্ভব শোষণ করে পুঁজিকে পুষ্টি দেওয়াই এই ভাঁওতার মূল লক্ষ। যে কারণে সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপত্তার নামে সীমান্তগুলো আরও বেশি কঠোর হয়ে উঠলেও, পণ্যের জন্য তা অবারিত হতে পেরেছে। আঞ্চলিক ক্ষুদ্র পুঁজিকে গিলে, আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজিকে জায়গা করে দেওয়ার ইচ্ছাকেই বিশ্বায়ন বাস্তবায়ন করেছে। এই বিশ্বায়ন ও এর ফলকে ঘরে তুলতে বিশ্বের শক্তিগুলো গোটা বিশ্বকেই প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। আর এই বাজার দখলের লড়াইয়ে নিঃস্ব হয়েছে লাখো মানুষ। এটা আক্ষরিক অর্থেই এক অনিঃশেষ যুদ্ধের শুরু করেছে, যার দামামা কখনো থামেনি। এই বিশ্বায়নের চাকা ধীর হয়ে পড়াটা তাই ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলছে পুঁজির কেন্দ্র দখলের চেষ্টায় থাকা অংশগুলোকে। আর শুরু থেকেই কেন্দ্রে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটি সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে নেমেছে; পুনর্বিবেচনা করছে যাবতীয় বাণিজ্য চুক্তিগুলোকে।

বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র তার মুদ্রা ডলারকে বরাবরই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ইরান, চীন, রাশিয়াসহ নানা দেশের সঙ্গে দ্বৈরথে এই অস্ত্র এখনো তারা ব্যবহার করছে। সর্বশেষ হুয়াওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাকে কানাডায় গ্রেপ্তার করা হয় যুক্তরাষ্ট্রেরই অনুরোধে। অপরাধ—যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা। যুক্তরাষ্ট্রে হুয়াওয়ের ব্যবসার ওপরও পড়তে পারে খড়্গ। এর অর্থ হচ্ছে চীনা এই কোম্পানিটি বৈশ্বিকভাবে আর ডলারে ব্যবসা করতে পারবে না। একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে চীনা আরেক কোম্পানি জেডটিইর ক্ষেত্রেও। মজার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞাগুলো আর আগের মতো কাজ করছে না। না এমন নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র রাতারাতি প্রভাব হারিয়েছে। বরং বলা ভালো যে, হারাতে বসেছে। কারণ আঞ্চলিক পরিসরে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। চীনা বিভিন্ন কোম্পানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এশিয়ায় ওই কোম্পানিগুলো ঠিকই ব্যবসা করতে পারছে। এবং এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর কোনো প্রভাব রাখতে পারছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিপরীতে চীনও বসে নেই। গত জুলাইয়েই তারা যেমন মার্কিন কোম্পানি কোয়ালকমের ডাচ কোম্পানি এনএক্সপি অধিগ্রহণ আটকে দিয়েছে। আর শুল্ক যুদ্ধ তো তারা সমানে সমানে চালাচ্ছেই। সঙ্গে রয়েছে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও নতুন সিল্ক রোড স্থাপনে চীনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। এ লক্ষ্যে চীন গোটা বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্র যে পন্থায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ নানা প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে ঋণজাল বিস্তার করেছিল, ঠিক একই পন্থায় এগোচ্ছে চীনও। বরং আরেকটু চতুর পন্থায় তারা সরাসরি বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হচ্ছে। ফলে ঋণের প্রসঙ্গটি আর সামনে থাকছে না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও এর সহযোগী বিভিন্ন সংস্থা ও মাধ্যম প্রতিনিয়ত চীনের এই প্রচেষ্টাকে একটি অপতৎপরতা হিসেবে দেখাতেই সচেষ্ট। কিন্তু পুঁজির এই উত্তরাধুনিক যুগে এসে আঞ্চলিকতাবাদ যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের এই চেষ্টা আগের মতো আর কাজ করছে না। বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সুদীর্ঘ মোড়লগিরি ও একচেটিয়াপনার ফলে এমনকি তার ইউরোপীয় মিত্ররাও নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার বাণিজ্য সম্পর্কগুলো পুনর্মূল্যায়নের পথ নেওয়ার পর ইউরোপ নিজ অঞ্চলের দিকেই বেশি মনোযোগী হয়েছে। এমনকি কানাডা ও মেক্সিকোর মতো দেশও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের নির্ভরতা কমানোর কথা ভাবছে।

বিশ্বায়নের গতি ধীর হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, প্রযুক্তিপণ্য বিশেষত তথ্যের প্রচলিত পণ্যের জায়গা দখল। সেবা খাত অনেক বেশি প্রসারিত হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির প্রচলিত ধারায় বদল এসেছে। আইএমএফের তথ্যমতে, ২০০৪-১৪ সময়ে উৎপাদন প্রবৃদ্ধির ৪০ শতাংশই এসেছে নতুন ধারণা ও জ্ঞানমূলক কাজ থেকে। নেটফ্লিক্স ও ফেসবুকের গ্রাহকের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। ই-কমার্সের পরিসর বাড়ছে ক্রমাগত। চলতি বছর চীনা ই-কমার্স কোম্পানি আলিবাবা অন্য দেশের গ্রাহক থেকে ৪ হাজার কোটি ডলার আয়ের আশা করছে। প্রযুক্তির বিস্তার কর্মসংস্থানের ধারায়ও বদল এনেছে। এখন বাংলাদেশে বসেই আউটসোর্সিং করছে লাখো তরুণ। ফলে প্রচলিত বাণিজ্যের ধারা ও এর সূচকগুলোয় বদল আসছে।

প্রযুক্তির এই বিস্তার আবার আরেক ধরনের শঙ্কা তৈরি করছে। বিশেষত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো বিষয়গুলো বড় ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। বিভিন্ন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে এই মাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়ে এরই মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আবার এসব মাধ্যমকে যতটা আন্তর্জাতিক বিবেচনা করা হয়, ততটা আন্তর্জাতিক এগুলো নয়। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুকের কথা বলা যায়। সারা বিশ্বেই ফেসবুক ব্যবহারকারী থাকলেও তার ধরনটি ঠিক আন্তর্জাতিক নয়। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কথা বলা যায়। এদের বন্ধুতালিকার ৭০ শতাংশেরই বাস ২০০ মাইলের মধ্যে। এ তালিকায় বিদেশির সংখ্যা মাত্র ৪ শতাংশ। অর্থাৎ নামে আন্তর্জাতিক হলেও তা আসলে আঞ্চলিকই। আবার চীনের মতো দেশগুলোর রয়েছে নিজস্ব অনুরূপ মাধ্যম। এমনকি ভারতও সম্প্রতি ওয়ালমার্টসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সামনে কিছু বাধার সৃষ্টি করেছে। মূল লক্ষ্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা ও দেশের মানুষের কর্মসংস্থান। অর্থাৎ এই বিস্তারও একধরনের রক্ষণশীলতার জন্ম দিচ্ছে পরোক্ষভাবে।

বিশ্বায়ন পুরো বিশ্বকে এক করেছে বলে দাবি করা হয়। এটা সত্য যে, আধুনিক অনেক সুযোগ-সুবিধা পুঁজির প্রয়োজনেই প্রান্ত রাষ্ট্রগুলোতে এনে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বায়ন ও এর মূল অস্ত্র মুক্তবাজার। কিন্তু এই সুযোগ-সুবিধাগুলোর জন্য প্রান্ত রাষ্ট্রগুলোকেও কম মূল্য চোকাতে হয়নি। আরও ভালো করে বললে প্রান্ত রাষ্ট্রগুলোর শাসকগোষ্ঠী নয়, মূল্যটি চুকিয়েছে সাধারণ মানুষ। এখন নানা তথ্য-উপাত্ত ও প্রবণতা বিশ্লেষণে বিশ্লেষকেরা বিশ্বায়নের গতি ধীর হচ্ছে বলে যে শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তা আদতে ঘনিয়ে আসা এক নতুন যুদ্ধ নিয়ে শঙ্কা। আর তা হলো আবারও নিজেদের মধ্যে বাজার পুনর্বিন্যাসের লড়াইয়ে নামছে বিশ্বশক্তিগুলো। মূল মঞ্চে এরই মধ্যে উপস্থিত চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। এ দুই পক্ষের একদিকে আশা, আরেক দিকে শঙ্কা। দুটিই কর্তৃত্বের জন্যই। অংশীদার হওয়ার লক্ষ্যে ময়দানে সমবেত আরও অনেকেই। এই নয়া ভাগ-বাঁটোয়ারায় এবার সাধারণ মানুষের ভূমিকা আর আগের মতো অতটা পরোক্ষ নয়। প্রযুক্তি তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেওয়ার ক্ষীণ হলেও একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোয় এই প্রতিযোগিতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ময়দানে দেখা দেবে পণ্য, মুদ্রা, প্রযুক্তি ও ধারণার লড়াই। এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জেতে তা-ই দেখার বিষয়। (শেষ)