সাবধান, ফেক নিউজ!

সম্প্রতি ওয়াশিংটনের রাস্তায় রাস্তায় ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার কপি ফ্রি বিলি করা হচ্ছিল। প্রথম পাতার পুরোটাজুড়ে বিশাল শিরোনাম: হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্পের প্রস্থান, সংকটের অবসান। প্রথম পাতার মাঝখানে ট্রাম্পের ছবি, গম্ভীর মুখ, পেছনে নিরাপত্তাপ্রহরী। খবরে বলা হয়েছে, প্রতিবাদের মুখে রুশ বিমানে করে ট্রাম্প সদলবলে ক্রিমিয়া ভেগে গেছেন। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, অবিকল ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা। বলা বাহুল্য, পুরোটাই মিথ্যা। অতি উৎসাহী ট্রাম্পবিরোধী এক বা একাধিক ব্যক্তির কাণ্ড। ডোনাল্ড ট্রাম্প যাকে ‘ফেক নিউজ’ বলেন, এটি তার একটি উত্তম উদাহরণ। তবে খুব বেশি লোক এই নকল পত্রিকা পড়ে ধরা খেয়েছেন, তা মনে হয় না। এর চেয়ে অনেক বেশি ‘ফেক নিউজ’ ট্রাম্প নিজে হরহামেশা ছড়াচ্ছেন, যার অধিকাংশই তাঁর অনুগত সমর্থকেরা বেদবাক্য বলে জ্ঞান করেন। যেমন বারাক ওবামা আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেননি—এমন ডাহা মিথ্যা কথা।

ট্রাম্পের কল্যাণে ‘ফেক নিউজ’ কথাটা এখন খুব জনপ্রিয় হয়েছে বটে, কিন্তু এর ব্যবহার অতি পুরোনো। আমরা যাকে গুজব বলি, তা ফেক নিউজ ছাড়া আর কিছু নয়। ফেক নিউজ কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তার সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ ইতালির ত্রেন্ত শহরে ১৪৭৫ সালের এক ঘটনা। এক ক্যাথলিক পাদরি রোববারের সাপ্তাহিক প্রার্থনায় বললেন, আড়াই বছরের এক বালককে অপহরণ করে একদল ইহুদি তাদের ‘পাসওভার’ উৎসবে খুন করে তার রক্ত পান করেছে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই শুধু এক গুজবের ভিত্তিতে সে শহরের প্রত্যেক ইহুদিকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকানো হলো। হত্যা করা হলো ১৫ জনকে।

ধর্মের নামে ফেক নিউজ ব্যবহারের উদাহরণ খুঁজতে আমাদের ইতালি যেতে হবে না। বাংলাদেশে এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে রংপুরের সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি নাকি ফেসবুকে মহানবী (সা.)–এর অবমাননা করেছে—এই গুজবের ভিত্তিতে ৩০টি হিন্দুবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, নিহত হয় একজন। পরে জানা গেল, পুরো ঘটনাই মিথ্যা। ২০১২ সালেও পবিত্র কোরআনের অবমাননা করা হয়েছে—এমন গুজব ছড়িয়ে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের উপাসনালয় ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

অর্থাৎ ফেক নিউজ আগেও ছিল, এখনো আছে। শুধু তফাত এই যে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ইত্যাদি ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এখন ফেক নিউজ ছড়িয়ে পড়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। ইন্টারনেটের সুযোগ আছে—এমন যে কেউ যেকোনো সময় মিথ্যা খবর ছড়াতে পারে। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে মিথ্যা রটনার নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছে কোনো কোনো দেশের সরকার ও সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা। আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এর সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত উদাহরণ।

বেশি দূরে যেতে হবে না। বাংলাদেশেই তো সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘ফেক’ অভিযোগে ফেসবুক ও টুইটার বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। দেখা গেছে, প্রথম আলোর মতো পত্রিকা বা বিডিনিউজ২৪-এর মতো জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের নাম ব্যবহার করে, অবিকল ডিজাইন নকল করে মিথ্যা ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে, যার লক্ষ্য এসব তথ্যমাধ্যমের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো। ফেসবুক জানিয়েছে, এসব ফেক ওয়েবসাইটের পেছনে সরকারি সমর্থন ছিল।

ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি, যে কারণেই ছড়ানো হোক না কেন, ফেক নিউজ বা গুজব ক্ষতিকর। এসব ছড়ানো অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ আমরা কীভাবে ঠেকাব? ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলের জন্য যা ক্ষতিকর, আমরা তা ঠেকানোর কাজ ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে করে থাকি। যেমন আমরা চোর–ডাকাত ঠেকাই। ফেক নিউজও ভিন্ন কিছু নয়। গর্ডন পেনিকুক ও ডেভিড র‍্যান্ড নামের দুই মার্কিন মনোবিশারদ রাজনৈতিক ফেক নিউজ সম্বন্ধে এক দীর্ঘ গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, কোনো মিথ্যা খবর পড়ার পর আমরা তা বিশ্বাস করি, কারণ আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই। রাজনৈতিকভাবে আমরা দলে, গোত্রে, শিবিরে বিভক্ত। কেউ যদি ট্রাম্পবিরোধী হন, তাহলে ট্রাম্প রাশিয়ায় পালিয়ে গেছেন—এই কথায় বিশ্বাস করবেন। কিন্তু কেউ যদি হিলারিবিরোধী হন, তাহলে হিলারি অত্যন্ত অসুস্থ, তিনি আর মাত্র কয়েক মাস বাঁচবেন—এমন গুজব তাঁরা বিশ্বাস করবেন।

রাজনৈতিক খবরের ব্যাপারে আমরা অনেকটা ভেড়ার পালের মতো। যে যার নিজের পালের সঙ্গে থাকতেই পছন্দ করি। এ কথা প্রমাণের জন্য কিছুদিন আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকা কে কোন খবর ‘শেয়ার’ করে, তা নির্ধারণের জন্য ‘ব্লু ফিড-রেড ফিড’ নামে একটি মজার প্রকল্প গ্রহণ করে। দেখা গেল, ব্লু বা ডেমোক্রেটিক ও রেড বা রিপাবলিকান-সমর্থকেরা সবাই শুধু একই ধরনের খবর একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করেছেন।

অথচ আমরা যদি নিজেদের ভেড়ার পাল-মনোবৃত্তি ত্যাগ করে চোখ-কান খোলা রাখতে শিখি, তাহলে ফেক নিউজে বিশ্বাস করার কোনো কারণ থাকে না। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব ফেসবুক ও টুইটারের। তাদের ব্যবহার করেই তো মিথ্যা ছড়াচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সৌভাগ্যের বিষয়, তারা উভয়েই ফেক নিউজ সামলাতে ‘পুলিশ প্রহরা’ বসাতে রাজি হয়েছে। এই পুলিশ প্রহরার বদৌলতেই বাংলাদেশের ফেক ফেসবুক ও টুইটার পেজগুলো বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তাদের ওপর চাপ বজায় রাখতে হবে।

আমরা নিজেরাও যার যার মতো এই প্রহরার কাজে নামতে পারি। ফেক নিউজ নজরে এলে তা ‘শেয়ার’ করার বদলে তাকে ফেক বলে যদি চিহ্নিত করি, তাহলে মিথ্যার আগুন ছড়ানোর বদলে তা নেভানো সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কী পড়বেন, কী শেয়ার করবেন, তা ঠিক তো আপনিই করছেন। শুধু এই কাজ যদি একটু দায়িত্বের সঙ্গে করেন, তাহলে বিপদ এমনিতেই কমে আসবে।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি