প্রাথমিকের বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় নারী ও পুরুষ

মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বইগুলোর একটি দিক আমার কিশোর মনে প্রায়ই প্রশ্নের অবতারণা করত। আমাদের সময় বিজ্ঞান বইয়ের ব্যবহারিক অংশের নাম ছিল ‘এসো নিজে করি’। ‘এসো নিজে করি’র পরীক্ষণে সব সময় ব্যবহার করা হতো ছেলের ছবি। মেয়ের ছবি প্রায় ছিল না বললেই চলে। অনেকটা সেই আশঙ্কা নিয়েই কদিন আগে হাতে তুলে নিয়েছিলাম জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রণীত প্রাথমিক স্তরের বিজ্ঞান বইগুলো। প্রাথমিক স্তরে বিজ্ঞান বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তৃতীয় শ্রেণি থেকে। যেহেতু বিষয়টি বিজ্ঞান, এ জন্য সম্পূর্ণ বইটিই স্বাভাবিকভাবেই পরিপূর্ণ রয়েছে বিজ্ঞানের তত্ত্ব আর তথ্যে। তাই নারী আর পুরুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আর তাদের চিত্রায়ণ মূলত প্রতিফলিত হয়েছে পাঠ্যবইয়ে ব্যবহৃত ছবিতে।

প্রথমেই হাতে তুলে নিয়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি। বইটি হাতে নিতেই কেন জানি বেরিয়ে এল ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠা। পৃষ্ঠার নিচের দিকে যে ছবিটি আমি লক্ষ করলাম, তা দেখে মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে গেল। সেখানে একটি পারিবারিক দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে, যেখানে পুরুষটি রান্না করছেন আর নারীটি কাপড় ইস্তিরি করছেন। নারী ও পুরুষের গৃহস্থালি কাজের এমন সমবণ্টন প্রাথমিক স্তরের অন্য কোনো বইয়ে এর আগে আমার চোখে পড়েনি। এ ছাড়া বইটিতে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী আর পুরুষের সম–অংশগ্রহণ দেখা গেছে। আমি দেখেছি, বিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষণে ছেলে আর মেয়ে একইভাবে অংশ নিয়েছে। ‘আমাদের জীবনে প্রযুক্তি’ অধ্যায়ে একজন নারীকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে মাইক্রোস্কোপে কাজ করতে দেখেছি, দেখেছি একজন কিশোরকে নলকূপের পানিতে কলসি ভরানোর দৃশ্য; যদিও এত অল্প বয়সে এত ভারী দুটি কলসি পূর্ণ করা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কি না, সে প্রশ্ন রয়ে যায় মনে।

তবে আশাহত হয়েছি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিজ্ঞান বইগুলো দেখে। বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে একইভাবে বারবার কর্মজীবী নারীকে শিক্ষকতা ছাড়া আর কোনো পেশায় দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে বইটি। এ ব্যাপারে উপরিউক্ত শ্রেণিগুলোর অন্যান্য বইয়েও কর্মজীবী নারীর পেশা অবধারিতভাবেই শিক্ষকতা! কিন্তু পুরুষ আবির্ভূত হয়েছেন ডাক্তার, অগ্নিনির্বাপণকর্মী, ব্যবসায়ীসহ নানান পেশায়। নারী পুনরুৎপাদনমূলক কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তিনি রান্না করছেন, সন্তানের যত্ন নিয়েছেন, সেলাই করে কাপড় পুনর্ব্যবহার করেছেন, সবজির বাগান কিংবা মুরগি পালন করেছেন। অন্যদিকে, পুরুষ ইট বানিয়েছেন, গাছ কেটেছেন, কীটনাশক ছিটিয়েছেন, আগুন নিভিয়েছেন, মাছ ধরেছেন কিংবা দোকান পরিচালনা করেছেন। আগুনজনিত দুর্ঘটনার অংশ হিসেবে চতুর্থ শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের ৮১ নম্বর পৃষ্ঠায় রান্নাঘরে ব্যস্ত নারীর শাড়িতে আগুন লাগার দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। ঠিক একই পাতায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র হাতে হাজির হয়েছেন পুরুষ। চতুর্থ শ্রেণিতে ‘আমাদের জীবনে প্রযুক্তি’ অধ্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রিকেট খেলা, কৃষিকাজ, কম্পিউটার টমোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদিতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষকেই চিত্রায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে, নারী শুধু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সুশোভিত রান্নাঘরে রান্না করেছেন কিংবা গান শুনেছেন। আরেকটি বিষয় ছিল লক্ষ করার মতো। পুরুষ যেখানে কাপড় ধুয়েছেন, সেখানে তাঁকে ধোপা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, একটি ছবিতে পুরুষকে দিয়ে রান্না করানো হয়েছে বটে তবে অ্যাপ্রোন পরিয়ে তাঁর কাজে পেশাদারি ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ফলে, কাপড় ধোয়া এবং রান্নায় সম্পৃক্ত হয়েও তাঁদের এই কাজগুলো গৃহস্থালি কাজ হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের ৩৭ পৃষ্ঠায় ক্ষিপ্রগতিতে সাইকেল চালানো একটি কিশোরী দৃষ্টি কেড়েছে। কিন্তু অবাক হয়েছি যখন বায়ুর উপস্থিতি প্রমাণ করার মাধ্যম হিসেবে সাইকেলে বসা মেয়েটির উড়ন্ত চুলকে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার পঞ্চম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে ‘বায়ুর ব্যবহার’ দেখাতে একটি নারীকে এলো চুলে চুল শুকানোর যন্ত্র হাতে দেখা গেছে।

প্রাথমিক স্তরের বিজ্ঞান বইগুলো দেখে মনে হয়েছে, নারী ও পুরুষকে মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ একটি অবস্থানে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পুরোপুরিভাবে সক্ষম হননি তাঁরা। পুরুষের আধিপত্যবাদ আজও গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে আমাদের মধ্যে, যা নিজের অজান্তেই হয়তো আমাদের পরিচালিত করে। তাই সামনের দিনগুলোতে আরও সতর্কতার সঙ্গে বইয়ের বিষয়বস্তু নির্বাচন, এর বিশ্লেষণ, বিন্যাস ও অলংকরণ করা জরুরি। বইয়ের রচনা ও সম্পাদনায় অধিকসংখ্যক নারীর উপস্থিতি হয়তো বিষয়টিকে সহজ করতে পারে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বইয়ের অলংকরণে আরও বেশি নারী চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণ। বৈষম্যমুক্ত আগামী প্রজন্ম গড়তে বইয়ের পাতায় ভারসাম্যপূর্ণ নারী-পুরুষের চিত্রায়ণ নিশ্চিত করতে হবে। আগামী দিনের পাঠ্যপুস্তকগুলো হয়ে উঠুক আরও সময়োপযোগী, আরও মানবিক, নান্দনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নারী-পুরুষের দৃশ্যমান বৈষম্যমুক্ত।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]