সংসদে ভিন্নমতের চর্চা চলুক

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভবিষ্যৎ কী? ব্রিটেনের যে দ্বিদলীয় মডেল অনুসরণ করার কথা আমাদের রাজনীতিবিদেরা কল্পনা করেছিলেন, তা আর কাজে দিচ্ছে না। পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সংসদীয় রীতিনীতির প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা পাল্টে যাচ্ছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কার্যকর করা হয়েছিল দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য। এখন সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে ঘিরে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মগজে খেলেছে যে ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদের ভেতরের বিষয়, বাইরের নয়। বিএনপি যেহেতু সংসদেই আসছে না, তাই সুলতানের দলত্যাগে ৭০ অনুচ্ছেদের আবরু রক্ষায় অসুবিধা হবে না।

এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে—সংসদের স্পিকার, আদালত ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রীতি হলো এই তিন প্রতিষ্ঠানই নিরপেক্ষ এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে শত হস্ত দূরে থাকবে। আজ সময় এসেছে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন না করেই কী করে ‘বিরোধিতা’ বা ভিন্নমতের চর্চা করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার। আমরা আর লুকাতে পারি না যে ৭০ অনুচ্ছেদের মূল চেতনা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না কিংবা এটা কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। যদিও ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার পক্ষে কেউ কেউ বলেন, মতপ্রকাশে বাধা নেই, ভোট দিতেই যত বাধা। কিন্তু যুক্তি হলো যদি ভোটই স্বাধীনভাবে না দিতে পারি, তাহলে স্বাধীন মতের কী দাম। আচ্ছা, তবে আপাতত এটা বজায় থাকতেও সমালোচনামূলক মতপ্রকাশে যে বাধা নেই, সেই চর্চা এবারে জোরসে চালু হোক।

কেউ কেউ বলেন, নিরঙ্কুশ বিজয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। আবার নিরঙ্কুশ পরাজয়েও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ঘটে। সাম্প্রতিক উদাহরণ ব্রেক্সিট ভোটাভুটি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী দেখলেন, তাঁরই দলের ১১৮ জন সাংসদ তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। আমরা শিশু গণতন্ত্রীরা ক্ষমতা প্রশ্নে ৭০ অনুচ্ছেদের কোনো শিথিল রূপ দিতে সংশোধন প্রস্তাব না হয় একরত্তি মানব না, কিন্তু তাই বলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনের লগ্নে, অত্যন্ত সীমিত কিছু ক্ষেত্র, যেখানে আলু-পটোলের মতো নীতি ঠিক হবে, সেখানে হুইপিং (দলীয় সিদ্ধান্তদানের প্রথা) তুলে নেওয়ার কথা ভাববই না? সংসদ গঠনের পরে সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের এবং সংরক্ষিত আসনে নারী বাছাইয়ে সংসদ নেতার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। পঁচাত্তরের পরে প্রথম শতভাগ ‘সিকি–আধুলি’মুক্ত আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা এসেছে। প্রধান বিরোধী দল থেকেও নেই। বলাই হয়েছে, আন্দোলন করে অবাধ নির্বাচন করার মুরোদ দেখানোই বিরোধী দলের যোগ্যতা, সেটা তো নেই। যা নেই, তা নেই।

আমরা তাই বলি, শাসনগত ইস্যুভিত্তিক বিরোধী কণ্ঠস্বর বা ভিন্নমত তৈরিতে এবারের মহা অনুকূল সুযোগ কাজে লাগানো হোক। এর আগে যুদ্ধাপরাধী ও প্রধান প্রতিপক্ষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো চাপের বিষয় ছিল। এই পর্বে তা নেই। আবার এই প্রথম একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে সংসদে একাধিক দলের পরিচয়সংকট দেখা দিয়েছে। রাশেদ খান মেনন ভেনেজুয়েলার মতো পরিস্থিতিতে পড়ার বিষয়ে সতর্ক করার পাশাপাশি এই অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন সংসদে তাঁদের ভূমিকা কী হবে। আমি তাঁকে এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরকে বললাম, এবারের অসুবিধা থেকে কী কী সুবিধা বের করা যায়, সেটা ভাবা যায়। মহাজোটের শরিকেরা যেহেতু মহাপরীক্ষিত মিত্র, তাই এবারের সংসদেই দলমত-নির্বিশেষে অনাস্থা প্রস্তাব, বাজেট ও প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় সংবেদনশীল বিষয় ছাড়া আর সব বিষয়ে মুক্তমনে আলোচনার দুয়ার খোলা যায়। হুইপদের ভিন্নরূপে দেখতে চাই। ওয়ান–লাইন, টু–লাইন,থ্রি–লাইন হুইপ পরিভাষাগুলো ব্যবহৃত হোক। ভারতে কংগ্রেস গত সপ্তাহে থ্রি–লাইন হুইপ জারি করেছে। এর অর্থ, দলটির সদস্যদের লোকসভায় হাজির এবং দলের সিদ্ধান্তে ভোট দিতেই হবে। স্যার আইভর জেনিংস বলেছিলেন, থ্রি–লাইন হুইপ মানে সংসদের বাইরের অন্য সব কাজ থেকে তিনি বিরত থাকবেন। গত সংসদে বিরোধী দলের নেতা ৫৬ ভাগ বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। জি এম কাদের থাকবেন। তাঁকে কথা বলার সময় বেশি দিন। সমালোচনাকালে তাঁর বা সরকারি–দলীয় সমালোচকদের মাইক যাতে বন্ধ না হয়। এটা ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায় না চাইলে হবে না। ভয় হয়, সংসদ ভবন স্তুতি ভবনে পরিণত না হয়।

বাকশাল বলেছিল, বিরোধী দল নিরর্থক। বাকশাল টেকেনি, কারণ, অনেকের মতে তা ছিল গণতন্ত্র ও উন্নয়নের বাধা। সেই পর্বে আমরা ট্রায়ালের সুযোগ নিইনি। এখন কপট বিরোধী দল হজম করছি। জিয়াউর রহমানের পর্বে আমরা হজম করেছিলাম কপট বহুদলীয় গণতন্ত্র। ছিল ফাঁকা বুলি, একটি ভাঁওতা। আসলে সবাই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চেয়েছেন। তাই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রেই এখন যতটুকু সম্ভব স্বচ্ছতা ও সুশাসনের শর্ত পূরণের চেষ্টা করে যাওয়া উচিত। স্টুয়ার্ট মিল সাহেবরা যে ধরনের সংস্কারপন্থী প্রগতিশীল বিরোধী দলের কথা লিখেছেলেন, এ দেশে তার প্রবেশ আরও দীর্ঘকাল নিষেধ থাকবে।

কোনটা পদত্যাগ, কোনটা দলের বিপক্ষে ভোটদান, সে সম্পর্কে স্পিকারের দায়িত্ব প্রত্যক্ষ। এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে তা নিষ্পত্তির জন্য তিনিই ইসিতে পাঠাবেন। সপ্তম সংসদে বিএনপির দুজন ভোল পাল্টে প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী হন। তাঁদের আসন শূন্য করতে বিএনপি চিঠি লেখে। তাঁরা পদত্যাগ কিংবা বিপক্ষে ভোট দেননি। স্পিকার ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন, বৈধতার প্রশ্নে অবশ্য একটি রুলিং দেন। পরে আপিল বিভাগ ‘মন্ত্রিত্ব নেওয়ায় তাঁদের সদস্যপদ সম্পর্কে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে’ পর্যবেক্ষণ দিয়ে ইসিতে পাঠায়। ইসি তাঁদের আসন শূন্য ঘোষণা করেছিল। মেজর আখতারুজ্জামান দলের নির্দেশ অমান্য করে সংসদের বৈঠকে যোগ দিলে বিএনপি আপত্তি তোলে। ইসি এ ক্ষেত্রেও আসন শূন্য করে। তাই ওই দুটি নজির বিবেচনায় নিলে সুলতান ও মোকাব্বিরের আসন থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা দেখতে আগ্রহী। এই সংসদ প্রশ্নবিদ্ধ বলে তারা কিছু ভালো কাজ করবে না বা আমরা আশাই করব না, সেটা অচল চিন্তা।   

হাসানুল হক ইনু ‘একাত্তর, পঁচাত্তর ও একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার খুনিদের জামাই আদরে’ সংসদে বসাতে রাজি নন। কিন্তু তাঁদেরই আমরা গণভবনে আপ্যায়িত হতে দেখলাম। এত কিছুর পরেও সেই বিএনপি বিএনপিই থাকল, সিকিরা সিকিই থাকল, আনা আনাই থাকল, সেটাও তো আমাদের মানতে হবে। সে জন্য আয়নায় চেহারা না দেখে আমজনতাকেই দুষব?   

জনাব ইনুর মতে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তিনি কোথায় পেলেন দেশে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ চলছে বা কখনো কার্যকর হয়েছিল? বিশ্বে পরাশক্তি বা সুশাসনের সঙ্গে উন্নয়নদাতা হতে হলে ‘প্রথাগত বিরোধী দল’ থাকতেই হবে, সেটা তো চীনা উদাহরণ নয়। চীনা একদলীয় শাসনে দলীয় পাচারকারীরা টাকা ফেরত দেয়, দণ্ড ভোগ করে। অথচ তথাকথিত ‘বিরোধী দল’ থাকতেও বিশ্বের অনেক দেশে তেমন কিছুই ঘটে না।  

সুতরাং বিরোধী দল কেন থাকবে? থাকলে কী শর্তে থাকবে? ৩০ ডিসেম্বরের মতো উপলক্ষ যে ‘বিরোধী দল’ উপহার দিল, তেমনটা ভবিষ্যতে আর কখনো হবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? এ রকম প্রশ্নগুলোর সদুত্তর দরকার। বিরোধী দল রাখলে সুশাসন দিতে না পারার অপারগতা আড়াল করা কি বেশিমাত্রায় সম্ভব হচ্ছে? নিশ্চয়তা চাই, ইনুর ‘খুনিরা’ বিরোধী দল হিসেবে অস্তিত্বহীন হয়ে গেলেই গণতন্ত্র ও সুশাসন ‘আপদ ও বিপদ’মুক্ত হবে। কেউ আমাদের বলুক, বিএনপিকে অস্তিত্বহীন করা কবে নাগাদ অর্জন করা যাবে? এখন বিরোধী দল যেভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে, মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের পরে সেটা কে কবে শুনেছে বা দেখেছে? সুশাসন থাকা বিশ্বের কোন অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় স্তম্ভগুলো একত্রে এমন অবস্থায় আছে?

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক