সংখ্যা নয়, মানের নিশ্চয়তা জরুরি

একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার এবং বেগম রোকেয়া পদকে পুরস্কারগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু একই সঙ্গে কমছে পুরস্কারের মর্যাদা। কারণ, রাষ্ট্রীয় এই সম্মান পেতে তদবির, রাজনৈতিক পরিচয়, স্বজনপ্রীতি প্রাধান্য পাওয়ার বেশ কিছু নজির সৃষ্টি হয়েছে। এসব পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা থাকলেও ব্যক্তি নির্বাচনে প্রশাসনের ইচ্ছাই হয়ে উঠেছে শেষ কথা। একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তা ২১ জনে উঠেছে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত জাতীয় জীবনে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চলতি বছর পর্যন্ত ৪৭৫ ব্যক্তি ও ৩টি প্রতিষ্ঠানকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। ২৬৩ ব্যক্তি ও ২৬ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতা পুরস্কার। স্বাধীনতা পুরস্কার প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে গত চার বছরে, প্রতিবছর পুরস্কার পাচ্ছেন ১৬ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। আর রোকেয়া পদকের সংখ্যা দুই থেকে বেড়ে গত দু-তিন বছরে পাঁচে উন্নীত হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত নারীর সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘একুশে পদক নীতিমালা, ২০১৭’ অনুযায়ী পদকের সংখ্যা সাধারণভাবে কোনো বছরে ১৫টির বেশি হওয়ার কথা নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে পদকের সংখ্যা বাড়াতে বা কমাতে পারে। কিন্তু ২১ ব্যক্তিকে এই পদক দেওয়ার যৌক্তিক কারণ কী, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এর আগে বিভিন্ন সময়ে দুই বা চারজন করে পদক দেওয়া হয়েছে কেন তারও সদুত্তর মেলে না।

সংখ্যা নিয়ে একই অবস্থা স্বাধীনতা পুরস্কারের ক্ষেত্রেও। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২০১৩ সালের সর্বশেষ নীতিমালায় বলা আছে, পুরস্কারের সংখ্যা সাধারণভাবে এক বছরে ১০টির বেশি হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় পুরস্কারের সংখ্যা বাড়ানো-কমানো যেতে পারে।

একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশ ও মানুষের কল্যাণে অসাধারণ, প্রশংসনীয় ও গৌরবোজ্জ্বল অবদান না থাকলেও ওপরমহলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ থাকায় অনেকে রাষ্ট্রীয় এই সম্মান পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে এই পদক ঘিরে বিতর্ক ও সমালোচনা বাড়ছে।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৬ সালে একুশে পদক এবং ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। আর রোকেয়া পদক দেওয়া শুরু হয় ১৯৯৫ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে। এই তিন পুরস্কারের প্রতিটির অর্থমূল্য এখন দুই লাখ টাকা, সঙ্গে স্বর্ণপদক ও সম্মাননাপত্র।

এসব পদক বা পুরস্কার বিতরণ–সংক্রান্ত বাছাই উপকমিটি রয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নেতৃত্বে। পরে ১২ সদস্যের জাতীয় পুরস্কার কমিটি, যার সদস্যদের সবাই মন্ত্রী, ওই তালিকা যাচাই-বাছাই করে তা পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য।

এ পর্যন্ত স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া ২৬৩ ব্যক্তির অর্ধেক বা ১৩২ জনই জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় এই স্বীকৃতি পাননি। আর একুশে পদকপ্রাপ্ত ৪৭৫ জনের মধ্যে মরণোত্তর পদক পেয়েছেন অন্তত ১০২ জন। এ ধরনের পুরস্কার জীবদ্দশায় না দিয়ে মৃত্যুর পর দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও বিশিষ্টজনদের কড়া সমালোচনা আছে। জীবিতাবস্থায় দেওয়া পদক ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত ও জনসমাজে সম্মানিত করে।

কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় এসব পুরস্কার পেয়েও নেননি। আবার কেউ কেউ প্রকাশ্যে বা আড়ালে দাবি করে তা আদায় করেছেন। নাম তালিকাভুক্ত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ন্যাপের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্বাধীনতা পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

আবার ক্ষোভ প্রকাশ করে পুরস্কার পাওয়ার নজিরও রয়েছে। ২০১৬ সালে অত্যন্ত সমাদৃত একজন কবি যেভাবে এ পুরস্কার পান, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গত বছরের ১০ মার্চ নিজের ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশ করার পর সেই কবির নাম যুক্ত করে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।

বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, এমন অনেক ব্যক্তিত্বও এসব রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাননি। দেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। ওই কমিশনের সদস্য হিসেবে ছিলেন তিন অর্থনীতিবিদ ড. মোশাররফ হোসেন (প্রয়াত), ড. আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তাঁদের মধ্যে একমাত্র রেহমান সোবহান ২০০৮ সালে স্বাধীনতা পদক পান।

পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকার–সমর্থকেরাই সব সময় বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। কখনো কখনো কম যোগ্যতা সত্ত্বেও অন্ধ দলীয় সমর্থককে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

শুরুর দিকে এবং এখনো মাঝেমধ্যে যোগ্যরাই পদক পেয়েছেন বা পাচ্ছেন। স্বাধীনতা পদক প্রবর্তনের পর দলীয়ভাবে পুরস্কার দেওয়া কঠিন ছিল। কারণ, শিল্প-সাহিত্য ও সংলগ্ন পেশায় কীর্তিমান ব্যক্তিদের প্রাচুর্য ছিল। তাঁদের উপেক্ষা করে কম যোগ্য ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়া ছিল বেশ কঠিন।

কোনো ব্যক্তি পুরস্কৃত হওয়ায় পুরস্কারের মহিমা বেড়েছে। এইচ এম এরশাদের সময় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা পুরস্কার নিতে আপত্তি করেননি। কারণ, পুরস্কার তখনো সরকারি নয়, রাষ্ট্রীয় বলেই গণ্য হতো। এরশাদ আমলে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর বা খালেদা জিয়ার আমলে রফিকুন নবীর পুরস্কারকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের যোগ্যতা ছিল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। শিল্পের উৎকর্ষে তাঁরা যেমন নন্দিত ছিলেন, তেমনই তাঁরা যুক্ত ছিলেন সমাজের নানা প্রগতিশীল আন্দোলনে। সরকার তাঁদের পদক দিয়ে প্রশংসিত হয়েছে।

পুরস্কার চালুর কয়েক বছরের মাথায় জিয়াউর রহমানের সময়েই কয়েকটি পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। স্বাধীনতার পরপর দালাল আইনে গ্রেপ্তার হওয়া খন্দকার আবদুল হামিদকে ১৯৭৭ সালে সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য একুশে পদক দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত শর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে শিক্ষায় স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার পর প্রবল বিতর্ক শুরু হয়। তাঁর সঙ্গে একই বছর শিক্ষায় ওই পুরস্কার পান জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্।

২০০৩ সালে বিএনপি সরকারের সময় স্বাধীনতা পুরস্কারের প্রবর্তক জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় বিএনপি। একই সঙ্গে তা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা কমিটি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কারটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করে এবং তা কার্যকর হয়।

অনেকের মতে, জনমনে এ ব্যক্তিদের অবস্থান এসব পুরস্কারের ঊর্ধ্বে। এ প্রসঙ্গে ২০১০ সালের জুলাইয়ে হাইকোর্টের একটি রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাতির জনকের নামে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন। তাই এই পদক প্রদান করে তাঁকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মতো ভাষাসৈনিক, কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। বাঙালির ইতিহাসে কালজয়ী এই ব্যক্তিদের পদক দেওয়ার মধ্যে অনেকে যুক্তি খুঁজে পান না।

আবার একাধিক রাষ্ট্রপতি, এক ডজনের বেশি মন্ত্রী এবং তাঁদের স্ত্রী-স্বজনেরা একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কারও কারও সত্যিকার অবদান থাকলেও বেশির ভাগই যে ক্ষমতায় থাকায় এসব পুরস্কার পেয়েছেন, সে সমালোচনা কখনো এড়ানো যায়নি।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার কজন পাবেন, কারা পাবেন এবং কী অবদানের জন্য পাবেন, তা নির্দিষ্ট করে কোথাও বলা নেই। সরকারের কাগুজে একটি নীতিমালা থাকলেও তা সচরাচর মানা হয় না।

যেকোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার বা একুশে পদক দিতে পারে। এই পুরস্কার নিয়ে প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে যে সমালোচনা আছে তা হলো, এসব পুরস্কারের জন্য প্রার্থীকে বা তাঁর পক্ষে মনোনয়ন দানকারীকে আবেদনের ৩০টি অনুলিপি জমা দিতে হয়। কৃতী ব্যক্তিরা নিজের উদ্যোগে এসব করতে স্বস্তি বোধ করেন না। জুরিবোর্ডে, মন্ত্রণালয়ে বা সরকারের কমিটিতে যাঁরা থাকেন, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য বিশিষ্ট নাগরিককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাঁদের ওপরই বর্তায়।

স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক বা রোকেয়া পদকের মতো সম্মান যথাযোগ্যদেরই পেতে হবে। যোগ্যতাই হতে হবে এর একমাত্র মাপকাঠি। সংখ্যা বাড়িয়ে নয়, মান নিশ্চিত করে পদক ও ব্যক্তির সম্মান রক্ষা করতে হবে।