নিপাট ভালো মানুষ ছিলেন তিনি

মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম
মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম

তিন দশকের বেশি সময় যাঁর সঙ্গে ওঠাবসা, সুদিন-দুর্দিনে আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেওয়া, সেই মানুষটি ৩১ জানুয়ারি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক—সবার কাছে সমভাবে জনপ্রিয় প্রবীণ শিক্ষকনেতা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম প্রসঙ্গে বলছি। তাঁর বিষয়ে এক-আধজন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ক্ষোভ ব্যক্ত করলেও কাউকে তাঁর নিন্দা করতে শুনিনি। ঢাকায় তাঁর আবাসস্থল মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন-সংলগ্ন মসজিদে শুক্রবার জানাজায় অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল উল্লেখ করার মতো।

এলাকাবাসীর মতে, এ ধরনের জনসমাগম তাঁরা আগে দেখেননি। শিক্ষক আন্দোলনের সব মত-পথের মানুষও এ জানাজায় অংশ নেন। শনিবার সকালে রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায় নিয়ামতপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের আগেভাগে সর্বশেষ জানাজায় অংশ নেন শত শত মানুষ। ঢাকা, পাংশাসহ দেশের সব এলাকার মানুষ তাঁকে চিনতেন, সবার মুখে মুখে এক কথা—আজিজুল ইসলাম ভালো মানুষ ছিলেন।

আজিজুল ইসলামের সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল ঢাকা মহানগরের কমিউনিটি সেন্টার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়, যা এখন তেজগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজ। শিক্ষকতা শুরু ১৯৬০ সালে বর্তমানের রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায় রতনদীয়া উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৬৮ সালে ওই এলাকার বি-কয়া উচ্চবিদ্যালয়ে। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগরের কমিউনিটি সেন্টার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় তখন থেকে, শিক্ষক আন্দোলনের সুবাদে। শিক্ষকদরদি প্রয়াত শিক্ষকনেতা শেখ আমানুল্লাহ আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন।

কেমন মানুষ ছিলেন আজিজুল ইসলাম? বিনয় ও পরিমিতিবোধের অধিকারী সদালাপী তো ছিলেনই। ছিলেন শিক্ষা উদ্যোক্তা। কমিউনিটি সেন্টার স্কুলে যখন যোগ দেন, সে সময় প্রতিষ্ঠানটির নামের সঙ্গে ‘আদর্শ’ থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, পাঠদান পরিবেশ—কোনোটাই আদর্শ ছিল না। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর স্কুলের নামে এক বিঘা জমি রেজিস্ট্রি হয় তাঁর হাত দিয়ে। তিনি স্কুলটিতে বিজ্ঞান শাখা চালু করেন। শিক্ষকতা জীবনে কখনো প্রাইভেট টিউশনি করেননি। তাঁর স্পষ্ট কথা ছিল, ক্লাসে ঠিকমতো পড়াতে হবে। ঘোরতর বিপক্ষে ছিলেন কোচিংয়ের। পরীক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে তাঁর উদ্যোগ ছিল উল্লেখযোগ্য। নম্বর পদ্ধতি থেকে গ্রেডিং ব্যবস্থায় রূপান্তরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে তখনকার চেয়ারম্যান ড. শরিফুল্লাহর সময় বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁর।

শিক্ষক আন্দোলনে তিনি যা অনভিপ্রেত মনে করতেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার বিরোধিতা করেছেন নীরবে, তবে সব সময় তাঁর নীতিগত অবস্থান ছিল সরবদেরই সঙ্গে। দেশ-বিদেশে নানা পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে কীভাবে অকৃত্রিম, শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখেন, অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন, তা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে একাধিকবার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজ এলাকায়, পাংশায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রচনায় তাঁর ভূমিকার কথা জেনেছি তাঁর পরিবারের কাছ থেকে। শিক্ষকনেতা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম সব দিক থেকে আসলেই একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁকে আমরা কোনো দিন ভুলব না।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ: শিক্ষক আন্দোলনে প্রয়াত মোহাম্মদ আজিজুল ইসলামের অন্যতম সহযোদ্ধা