আরব বিশ্বের ভুল রাজনীতি ও আমরা

সৌদি হামলায় ইয়েমেনের বহু জনপদ এ রকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে
সৌদি হামলায় ইয়েমেনের বহু জনপদ এ রকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে

সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশ ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিরক্ষা সমঝোতা চুক্তি সই করতে চলেছে। এর আওতায় ইয়েমেন সীমান্তে ১ হাজার ৮০০ বাংলাদেশি সেনা নিয়োগ দেওয়ার কথা। সৌদি আরবের ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেররিজম কোয়ালিশনে (আইএমসিটিসি) বাংলাদেশ থেকে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ চারজন কর্মকর্তাকে নিয়োগের জন্য নামও দেওয়া হয়েছে বলে খবরে এসেছে। দেশের ভেতরে–বাইরে খবরটি সংগত কারণেই গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হবে। কেননা, মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধপূর্ণ ভূরাজনীতিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সরাসরি অংশগ্রহণ প্রকাশ্যে এল এই প্রথম।

২০১৫ সালে যখন সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগে বাংলাদেশ নাম লিখিয়েছিল, আমি বলেছিলাম, বিষয়টি আমাদের জন্য কতটা ইতিবাচক হবে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা জরুরি। খটকা ছিল তখনই। কারণ, সৌদি যেটাকে ৩৪ দেশের সামরিক জোট বলছিল, আমরা তখন সেটিকে সন্ত্রাসবিরোধী সমন্বিত উদ্যোগ বলেছি। ভাষার দিক দিয়ে ব্যাপারটা যা–ই হোক, এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধপূর্ণ রাজনীতিতে যে বাংলাদেশ একটি পক্ষ নিয়ে নিয়েছে, তা নিশ্চিত। প্রস্তাবিত চুক্তি বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তুলবে নিঃসন্দেহে।

বাংলাদেশের সংবিধান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি বজায় রাখতে বলেছে। দুই দিক দিয়ে বিদেশনীতি পর্যালোচনার দাবি রাখে, প্রথমত দেশের বাইরে সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না; দ্বিতীয়ত আমাদের সামরিক বাহিনীর বিদেশে উপস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি কী দাঁড়াবে। যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নীতি আমাদের নেই। সংবিধানে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধেও সুস্পষ্ট অবস্থান আছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বিবদমান পরিস্থিতিতে একটি পক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়া আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও আঞ্চলিক বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ আরব বিশ্বের দেশ নয়। আরবের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিল না। বাংলাদেশ এর আগে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়াদি নিয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সরাসরি সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। ফলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিদেশনীতি সব সময়ই বাংলাদেশের জন্য বজায় রাখা সহজ ছিল। কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে অতিঘনিষ্ঠতা সেই ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে অস্থিতিশীল ও দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বয়ে এনেছেন দেশের জন্য সুনাম। সেই ভূমিকার সঙ্গে এই উদ্যোগকে এক করা যাবে কি না, তা আলোচনার দাবি রাখে। ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের পরে ১৯৯১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সৌদি আরব থেকে ইরাকে অভিযান চালিয়েছিল। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তখন কুয়েতকে মাইনমুক্ত করতে সহায়তা করে। সেই সময় আন্তর্জাতিকভাবে এই অভিযান ভিন্নভাবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু বিরোধপূর্ণ ইয়েমেন সীমান্তে এবার বাংলাদেশের সেনা মোতায়েনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। যদিও বলা হচ্ছে, সীমান্তে আমাদের সেনারা মাইন অপসারণের কাজ করবে। তারপরও ইয়েমেনে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক তৎপরতাকে বিবেচনায় নিলে এই সংযুক্তিকে কোনোভাবেই যুদ্ধ অবস্থায় অংশগ্রহণের বাইরে অন্য কিছু হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ না–ও থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইয়েমেনকে কেন্দ্র করে বিশ্বরাজনীতির যে মেরুকরণ, সেখানে বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট পক্ষাবলম্বন ভবিষ্যতে আমাদের অনেক বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভালোভাবে না–ও নিতে পারে।

ইয়েমেনে আল–কায়েদার শক্তিশালী অবস্থানকে যেভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে, সেই বাস্তবতা মাথায় রাখা জরুরি। আরব বসন্তের আরেক সর্বনাশা পরিণতি ইয়েমেন। দারিদ্র্যপীড়িত এই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে ক্ষমতার পালাবদল ও গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নয়, বরং সৌদি নেতৃত্বে আট সুন্নি দেশ ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা সেখানকার সংকট ঘনীভূত করতে অভিযানের পর অভিযান চালিয়েছে। জাতিসংঘের ভাষায় এটিই বিশ্বের সবচেয়ে মানবসৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়। এই সুযোগে আল–কায়েদা ইন দ্য আরব পেনিনসুলা আর ইসলামিক স্টেট গ্রুপ ভালোভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর দাবি। এখন সেখানে সেনা পাঠালে, তারা যে কাজই করুক না কেন, আমাদেরকে ভবিষ্যতে সৌদি আরবের পক্ষের সামরিক শক্তি হিসেবেই ধরা হবে। ইয়েমেন সংকট নিরসনে জাতিসংঘের তিনটি সংস্থা বারবার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সেখানে শান্তিরক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। এখন ইয়েমেনে অভিযান পরিচালনাকারী সৌদি নেতৃত্বাধীন শক্তিগুলো সীমান্তে মাইন অপসারণের মতো কাজগুলো নিজেদের আওতায় করিয়ে শান্তিপ্রক্রিয়ার কাজ চালানো হচ্ছে বলে বিশ্বকে দেখাতে পারে। এমন একটি কৌশলগত খেলায় আমাদের সংযুক্তি ভবিষ্যতে নিজেদের জন্যই ইতিবাচক না–ও হতে পারে।

সাম্প্রতিক কাতার সংকট ভুললে চলবে না। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের ক্ষেত্রে সৌদি ও তার মিত্ররা যে আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ ভাবমূর্তিকে স্পষ্ট করে। কাতার নিজেদের উদ্যোগে সংকট উতরেছে ঠিকই, কিন্তু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরবদের আঞ্চলিক জোট জিসিসি দুর্বল হয়ে গেছে। স্পষ্টত বিভক্তি দেখা দিয়েছে। সে কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এমনকি বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্রও কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতার দিকে খেয়াল করলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়া ও চীন—দুই দেশের পরিচিতিই সৌদি স্বার্থের বিরোধীপক্ষ হিসেবে। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সমীকরণের কারণে সেই তারাও দৃশ্যত কোনো পক্ষের সঙ্গে পুরোমাত্রায় তিক্ততা রাখতে চায় না। অথচ সেখানে আমাদের আচরণ ঠিক উল্টো। বিশ্বে এমনিতেই সৌদির সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে বলে ধরা হয়। এখন আমরা তাদের সঙ্গেই সামরিক সমঝোতা করছি এবং একটি যুদ্ধফ্রন্টের অংশ হচ্ছি। স্বভাবতই সৌদিবিরোধী শক্তিগুলো আমাদের ব্যাপারে আরও নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্বরাজনীতিতে সৌদি আরব সব সময়ই পশ্চিমাদের স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের যত রকমের চেষ্টা, সব কটিতে সৌদিদের ভূমিকা টের পাওয়া যায়। তাদের নতুন বাদশাহি নিয়ে কিছুদিন নানা রকম উচ্ছ্বাস থাকলেও সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছে যে সৌদি আরব তাদের কৌশলগত অবস্থান থেকে এতটুকু নড়েনি।

সৌদি আরবের সঙ্গে এই সমঝোতা চুক্তি হয়তো চটজলদি আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা কি খুব বেশি লাভ বয়ে আনবে? বিশেষ করে যেখানে সৌদি মধ্যপ্রাচ্যে আরও আগ্রাসী হওয়ার জন্য তাদের সামরিক বাজেট ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে, সেখানে বলাই যায়, ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামরিক তৎপরতার ভাবনা তাদের মাথায় থাকবে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) বলেছে, বিশ্বে সামরিক বাজেটে সৌদি এখন তৃতীয়। ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়েছে তারা। অন্যদিকে সিরিয়ায় তৎপর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্রের অন্যতম জোগানদাতা হিসেবে সৌদি আরবের নাম এসেছে। এর আগে রিয়াদ ইরাকের সন্ত্রাসীদেরকেও অস্ত্র জোগাত। উপরন্তু আরব দেশসমূহের বর্তমান সংকটের জন্য আমাদের মিত্রদের অনেকে দায়ী করে সৌদিকেই।

সৌদি আরবের সঙ্গে বিরোধে থাকা ইরানি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, সামরিক খাতে সৌদি আরবের ব্যাপক অর্থ বরাদ্দের প্রধান লক্ষ্যই হলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা। সৌদি আরব ২০১১ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে এবং বেআইনি প্রক্রিয়ায় সেসব দেশের সরকার বদলেরও চেষ্টা চালাচ্ছে। সৌদি আরব মূলত গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে সামরিকীকরণের মাধ্যমে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। দেশটি আগের বছরের তুলনায় সামরিক খাতে ৯ দশমিক ২ শতাংশ বেশি ব্যয় করেছে। অথচ তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক নিম্নগামী। কদিন আগেই কাতারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হামাদ বিন জাসিম বিন জাবোর আলে সানি বলেছেন, তাঁর দেশের ওপর সৌদি অবরোধ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে মারাত্মক অনাস্থা তৈরি করেছে। জিসিসি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে বহু বছর সময় লাগবে। তাঁর কথায়, আরও বড় যুদ্ধে জড়ানোই সৌদি আরবের বর্তমান শাসকদের লক্ষ্য।

সৌদি আরবের বিরোধীপক্ষ প্রকাশ্যেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছে যে সৌদি সামরিক জোটে যেসব দেশ রয়েছে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আইএস (ইসলামিক স্টেট) লালনের অভিযোগ আছে। তারা শিয়া-সুন্নি বিভাজনে ভূমিকা রেখেছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে তাদের ভূমিকা স্পষ্ট ছিল না। মার্কিনদের ফিলিস্তিনবিরোধী ভূমিকায় সৌদি আরবকে নীরব থাকতে দেখা গেছে। সৌদি-ইসরায়েল যোগাযোগ এখন স্বাভাবিক কূটনীতিতে পরিণত হয়েছে। এ রকম একটি জটিল আবহে সৌদি আরবের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতিতে আমরা সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়তে চলেছি। কে জানে, এই সিদ্ধান্ত আরব বিশ্বের ভুল রাজনীতির সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎকে যুক্ত করে ফেলছে কি না। তাই সবিনয়ে বলি, এমন স্পর্শকাতর উদ্যোগের লাভ–ক্ষতি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা খুব জরুরি।

ফজলে হোসেন বাদশা, সংসদ সদস্য, রাজশাহী-২, সাধারণ সম্পাদক; বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি