নারীদের বেতনহীন কাজের স্বীকৃতি চাই

দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সভা শুরুর আগে অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে বছরে নারীদের বেতনহীন কাজের অর্থমূল্য রীতিমতো বিস্ময়কর—১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোম্পানি অ্যাপলের বার্ষিক ব্যবসার ৪৩ গুণ বেশি।

১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের সময় ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের বেতনহীন কাজের বার্ষিক অর্থমূল্য হিসাব করলে দাঁড়াবে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন থেকেই নারীদের বেতনহীন ও সেবামূলক কাজ সারা বিশ্বে অধিকার ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে এমন সংস্থাগুলোর ব্যাপক আলোচনার একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নারীদের বেতনহীন ও সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি এসডিজির লক্ষ্য-৫–এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা। তবে এখন পর্যন্ত এ লক্ষ্য অর্জনে রাষ্ট্রগুলো সামান্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। এরা নীতিনির্ধারক ও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করছে যে নারীদের বেতনহীন কাজের প্রতি অস্বীকৃতি তঁাদের অবদানের অবমূল্যায়ন করছে। এটি তাঁদের প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতারও পথ করে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের অনেক অর্জন থাকলেও উচ্চমাত্রায় পারিবারিক সহিংসতা প্রমাণ করে যে ঘরে এখনো তঁাদের যথেষ্ট ক্ষমতায়ন হয়নি। তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা খুবই কম। নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষশাসিত সংসারে ক্ষমতা বা মর্যাদার দিক থেকে অধীনস্থ থাকেন। সারা দিন তাঁরা গৃহস্থালির যেসব কাজ করেন, যেমন সবকিছুর দেখাশোনা, রান্নাবান্না, সবজি বাগানের কাজ, গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির যত্ন নেওয়া এবং কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য জরুরি কাজ—এসবই সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়। নারী নিজে কিংবা তঁার পরিবারের সদস্যরা কেউই মনে করেন না যে তঁার অবদান পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক মঙ্গলের জন্য খুবই জরুরি। মনে করা হয়, নারীদের পালন করা দায়িত্ব কেবলই পুনরুত্পাদনশীল কাজ, যা তঁারই দায়িত্ব। এতে তঁাদের কাজের উত্পাদনশীলতার দিকটিকে অবহেলা করা হয়।

২০১৫ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) জন্য সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘নারীদের হিসাবহীন কাজ ও অর্থনীতিতে অবদান’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, একটি পরিবারে একজন নারী গড়ে প্রতিদিন ১২ দশমিক ১ এসএনএ (জাতীয় হিসাবপদ্ধতি) বহির্ভূত কাজ করে থাকেন। এসএনএ–বহির্ভূত আয় অর্থনৈতিকভাবে দৃশ্যমান নয় এবং তা জিডিপিতে ধরা হয় না। বিপরীতে পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যের গড় এসএনএ–বহির্ভূত কাজ মাত্র ২ দশমিক ৭। গবেষণার সারমর্মে বলা হয়েছে, নারীদের এসএনএ–বহির্ভূত অর্থাৎ বেতনবিহীন গৃহস্থালি কাজের আনুমানিক আর্থিক মূল্য হবে জিডিপির (অর্থবছর ২০১৪-১৫) ৭৬ দশমিক ৮ থেকে ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশের সমান। তবে এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে যদি নারীদের বেতনহীন কাজের অর্থমূল্য হিসাব করা হয়, তা হবে বেতনভুক্ত কর্মীদের তুলনায় ২ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৯ গুণ বেশি। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে, যদি একজন নারী প্রতি মাসে পোশাক কারখানায় কাজ করে ৫ হাজার টাকা পান, সেখানে বেতনহীন কাজ করা একজন নারীর প্রাপ্য হওয়ার কথা ১৫ হাজার টাকা।

অক্সফামের গবেষণাটি বলছে, নারীদের কাজের প্রতি অবমূল্যায়ন একটি বৈশ্বিক চিত্র। গবেষণায় দেখা গেছে, আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে মোট মৌলিক খাদ্যদ্রব্যের শতকরা ৬০ থেকে ৮০ ভাগ উত্পাদন করে থাকেন নারীরা। আর এশিয়া অঞ্চলের ব্যাপক পরিসরের ধান চাষের ক্ষেত্রে শ্রমের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি দিয়ে থাকেন নারীরাই। আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে ৬০ ভাগের বেশি পরিবারের প্রধান নারীরা। তঁারা গৃহস্থালির কাজ, পানি ও জ্বালানি সরবরাহের শতকরা ৯০ ভাগ চাহিদা পূরণ করেন। আর পারিবারিক সাধারণ খাদ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াকরণের শতকরা ১০০ ভাগ কাজই করেন তাঁরা। তবে এসব ইতিবাচক পরিসংখ্যান সত্ত্বেও সারা বিশ্বের গ্রামাঞ্চলে ৫০ কোটি নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। অক্সফামের অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে জমির মালিকানার ক্ষেত্রে নারীদের হার পুরুষের ৫ ভাগের ১ ভাগ। অথচ ধান উত্পাদনে প্রয়োজনীয় ২২টি কাজের মধ্যে ১৭টিই করেন নারীরা।

নারীদের বেতনহীন কাজের স্বীকৃতি না মেলার কারণে তাঁদের উত্পাদনশীল শক্তিরূপে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। নারীদের অবদানের অদৃশ্যমানতার ফলে তঁাদের অবমূল্যায়ন করা হয় এবং পরিবার ও সমাজে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হয়। অপরদিকে, কৃষি, বনায়ন, মত্স্য চাষ ও গরু-ছাগল পালনের মতো পেশাগত কাজে নিয়োজিত দুই কোটির বেশি নারীর অবস্থাও এর চেয়ে মোটেই ভালো নয়। তাঁদের পরিশ্রম করতে হয় হাড়ভাঙা, অথচ একই কাজের জন্য পারিশ্রমিক পান পুরুষদের চেয়ে অর্ধেক। এরপরও তাঁদের ঘরে ফিরে স্ত্রী, মা বা গৃহকর্ত্রী হিসেবে সমাজের আরোপিত নানা সাংসারিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয়। এ জন্য যে সামান্য পারিশ্রমিক তঁারা পান, তা-ও প্রায় সময়ই পরিবারের জন্য ব্যয় করে ফেলেন। এতে নারীরা আগের মতোই দরিদ্র এবং ক্ষমতাহীন থেকে যান।

তাই দশকের পর দশক ধরে বিরাজমান ভুলত্রুটি ও অন্যায়গুলো শোধরানোর এখনই উপযুক্ত সময়। নারীদের বেতনহীন কাজের স্বীকৃতি (যা এসডিজি-৫–এ অন্তর্ভুক্ত) নিয়ে কথাবার্তা অনেক হলেও বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ খুব কমই নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতিবিদদের প্রতি আমাদের জোরালো আবেদন, এসএনএ (জাতীয় হিসাব পদ্ধতি) পরিমাপের এমন একটি পদ্ধতি বের করুন, যাতে নারীদের বেতনহীন কাজ জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। মেক্সিকো, ভারত ও নেপালের মতো কয়েকটি দেশ ‘স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম’ নামে একটি পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে, যাতে প্রতীকীভাবে হলেও নারীদের বেতনহীন কাজকে হিসাবের মধ্যে এনে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমাদের চাহিদা পূরণে এটি কোনো আদর্শ ব্যবস্থা না হলেও আপাতত আমরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারি।

অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ লক্ষ্যে উদ্যোগ নিলে তা নারীদের বেতনহীন কাজের উপেক্ষিত বিষয়টিকে মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। এর ফলে সমাজের মানুষ নারীদের ভূমিকা, দায়িত্ব ও অবদানকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে বাধ্য হবে। এতে পরিবারে তাঁদের মর্যাদা বাড়বে এবং সমাজেও ভাবমূর্তি উন্নত হবে। এর ফলে নারীদের কাজ এবং উত্পাদনের সম্পর্ক সবার কাছে পরিষ্কার হবে। কে জানে, সে দিনটি হয়তো আর বেশি দূরে থাকবে না, যেদিন অর্থনীতিবিদেরা এসএনএর হিসাব–নিকাশ পুনর্মূল্যায়ন করতে বসবেন এবং আবিষ্কার করবেন নারীদের বেতনহীন কাজকে যথাযথভাবে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার এক নতুন সূত্র।

শাহীন আনাম: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক