পুরস্কারের কী, কে ও কোথায়

কদিন আগে জেনেছিলাম, আফসান চৌধুরী এ বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। শুনে খুব ভালো লেগেছিল। আফসান চৌধুরীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ নেই, কিন্তু আমি তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত। যে বিশাল কাজ তিনি করেছেন এবং করে চলেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ওপরে, মুগ্ধতার সঙ্গে তা আমি অনুসরণ করেছি। আফসান চৌধুরীর এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমার মনে হয়েছে, একটি অনন্যসাধারণ কাজের জন্য একজন যোগ্য মানুষের কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি।

কিন্তু এ কথাগুলো সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্তের সম্পর্কে কি বলা যাবে? অনেক সময়ে আমরা তর্ক করি যে যাঁকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তিনি যোগ্য ব্যক্তি সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর চেয়েও যোগ্যতর ব্যক্তি আছেন। এ বিতর্ক স্বাভাবিক, কারণ যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কাকে পুরস্কার দেওয়া উচিত, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকতেই পারে। প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ আছে। কিন্তু পুরস্কার যখন যোগ্যতার ধার ধারে না, কোনো সৎ নির্ণায়কে যখন পুরস্কারের যৌক্তিকতা সমর্থন করা যায় না, তখন পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম দেখে হতবাক হয়ে যেতে হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, সব পুরস্কারে কিছু রাজনীতি, কিছু পক্ষপাত, কিছু অন্য বিবেচনা কাজ করে। কিন্তু অন্য সব বিবেচনা যখন যোগ্যতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন হতবাক হওয়া ছাড়া আর কীই–বা করা যায়?

পুরস্কার একধরনের স্বীকৃতি। কাজের, অবদানের ও অর্জনের স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি দেয় সম্প্রদায়, সমাজ ও দেশ। কখনো কখনো সে স্বীকৃতি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যের একটি কাজের পুরস্কার, যেমন পুলিৎজার পুরস্কার বা বুকার পুরস্কার। আবার কখনো কখনো কোনো কোনো পুরস্কার কোনো একটি বিষয়ে সারা জীবনের অবদানের স্বীকৃতি। যেমন নোবেল পুরস্কার।

বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হচ্ছে স্বাধীনতা পুরস্কার। জাতীয় জীবনে কিংবা সরকার–নির্ধারিত ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এ পুরস্কার প্রতিবছর দেওয়া হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হচ্ছে একুশে পদক। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রতিবছর একুশে পদক প্রদত্ত হয়। বাংলাদেশের একটি অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার হচ্ছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এটিও একটি বাৎসরিক পুরস্কার, যা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রদেয়।

তিনটি পুরস্কারের দিকে তাকালেই যে শব্দটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে দ্যুতিময়, সেটি হচ্ছে ‘অবদান’। শব্দটির চেতনার সঙ্গে তিনটি ধারণা নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এক, ‘অবদান’ শব্দটি সারা জীবনের অর্জনের সঙ্গে সংযুক্ত, ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ নয়। দুই, ‘অবদানের’ দাবি অর্জনের জন্য একজন মানুষের একটি ন্যূনতম সময়সীমার প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট ইতিবাচক অবদান যে নেতিবাচক কাজ দ্বারা ম্লান হয়ে যায়নি, সেটা নিশ্চিত করার জন্যও সময়সীমা গুরুত্বপূর্ণ। তিন, জীবনব্যাপী এ–জাতীয় অবদানের একটি ব্যাপক গণস্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন।

উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে বাংলাদেশের প্রধান তিনটি পুরস্কারের কী ও কেন বিধৃত হয়েছে। এখন মন দেওয়া যাক ‘কে’ এবং ‘কোথায়’ প্রশ্নে। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারের দিকে যখন তাকাই, তখন কতগুলো ব্যতিক্রম মেলাতে পারি না। কবর নাটকের নাট্যকার শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে একুশে পদক দেওয়া হয়নি। এ পদক পাননি বায়ান্নর সৈনিক প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম। কত অভিনেতা-অভিনেত্রী একুশে পদক পেলেন, কিন্তু প্রয়াত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন ও সুমিতা দেবীকে তা দেওয়া হয়নি। যদিও ‘অভ্র’ আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে দমকা হাওয়ার মতো, তার উদ্ভাবক মেহেদী হাসান খানকে আজ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান কিংবা অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন (মরণোত্তর) কি বিবেচিত হতে পারেন না স্বাধীনতা পুরস্কার কিংবা একুশে পদকের জন্য? তালিকা দীর্ঘ করব না, কিন্তু এ রকম বহুবিধ নাম উচ্চারিত হতে পারে এসব পুরস্কার ও স্বীকৃতির ক্ষেত্রে। এবার ‘কোথায়’ ব্যাপারটি তলিয়ে দেখা যাক। এসব পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা ও বিচারকেরা কেন জানি তাঁদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখেন শুধু দেশের ভূখণ্ডের মধ্যে। এমন কি কোনো নিয়ম আছে যে এ পুরস্কারগুলোর জন্য যাঁরা দেশের ভেতরে আছেন, তাঁরাই শুধু বিবেচিত হবেন? যাঁরা অনাবাসী, তাঁরা কেন পরিত্যাজ্য হবেন? সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো কোনো কোনো সংরক্ষিত পুরস্কার বরাদ্দ অনাবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। যেমন বাংলা একাডেমির সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার অনাবাসী সাহিত্যিকদের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে কেন অনাবাসী লেখকেরা বিবেচিত হবেন না মূলধারা বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য? এ অসম ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।

এই বিশ্বায়নের যুগে মানুষের ভৌগোলিক অবস্থান বড় কথা নয়, সবচেয়ে বড় কথা তাঁদের অঙ্গীকার, অর্জন ও অবদান। শিল্প–সাহিত্য ও বিজ্ঞানে বাংলাদেশি মেধা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক বলয়ে তাঁদের অর্জন ও অবদান স্বীকৃত বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সব অনাবাসী বাংলাদেশি এক টুকরো বাংলাদেশ তাঁদের হৃদয়ে সর্বদা বহন করেন। বাংলাদেশ তাঁদের গর্ব। পেছনে ফেলে আসা দেশটির জন্য তাঁদের মনে অদ্ভুত মায়া ও মমতা।

সে মায়া–মমতা থেকেই তাঁরা অবিস্মরণীয় কত কিছু করেন তাঁদের মাতৃভূমির জন্য। এই যে এ মাসের ২১ তারিখে সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হবে, সে তো কানাডাপ্রবাসী দুই বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের নিবিড় কাজের ফল। লন্ডনপ্রবাসী কবি ও লেখক শামীম আজাদের বহুমাত্রিক স্বপ্ন ও দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল ‘বিজয়ফুল’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ধ্যানধারণা, স্বাধীনতার ইতিহাস, চূড়ান্ত বিজয়ের চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা বিশ্বে। এসব কার্যক্রম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরিত হয় সারা বিশ্বে। কিন্তু এসবের দেশজ স্বীকৃতিও যে বড় প্রয়োজন। অনাবাসী বাংলাদেশিরা তাঁদের কাজের স্বাভাবিক স্বীকৃতিটুকু চান, দেশের জন্য কিছু করতে চান। দেশ ও মানুষের স্বীকৃতি সবচেয়ে বড় অনাবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। এবং সে পুরস্কারটি হতে হবে মূলধারার, অনাবাসীদের জন্য সংরক্ষিত কোনো বিশেষ পুরস্কার নয়।

সেই পরিপ্রেক্ষিতে যদি আবার বিদেশের ‘কে’ বিষয়ে ফিরে যাই, তখন অবাক নয়, হতবাক হই। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিবিসির সিরাজুর রহমান বা কলকাতায় কূটনীতিক হোসেন আলীর অবদানের কথা সর্বজনবিদিত। ঠিক জানি না, তাঁরা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন কি না। সারা জীবন ইতালিতে বসবাসকারী প্রয়াত ঔপন্যাসিক শামসুদ্দীন আবুল কালাম, লন্ডনপ্রবাসী লেখক–গবেষক অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ, কিংবা কবি–লেখক শামীম আজাদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি। জানি বাংলা একাডেমি পুরস্কার মরণোত্তর দেওয়া যায় না, সুতরাং শামসুদ্দীন আবুল কালামের তা পাওয়ার আর সম্ভাবনা নেই, কিন্তু বাকি দুজন? অর্থনীতির অধ্যাপক এ আর খান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তাঁকে কি বিবেচনা করা যায় না একুশে পদকের জন্য?

কিন্তু একটি কথা দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলতে চাই। স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো পুরস্কারই এমন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যাবে না, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতাসংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। পুরস্কার নয়, শাস্তিই তাদের প্রাপ্য। আর মানবতাবিরোধী কাজ যারা করেছে, তাদের চরম শাস্তিই দেওয়া উচিত। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে শর্ষিনার পীরের মতো মানুষকে স্বাধীনতার পদক প্রদান করে আমাদের দেশ ও স্বাধীনতার যে ঐতিহাসিক অবমাননা করা হয়েছে, সে পদক অবিলম্বে ফেরত নিয়ে এ অনাচারের বিহিত করা একটি আশু কর্তব্য।

একটি পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং শ্রদ্ধাশীলতা নির্ভর করে তার সততা ও বিশুদ্ধতার ওপরে। পুরস্কারের ‘কী, কেন, কাকে ও কোথায়’ এ সততা ও বিশুদ্ধতার কেন্দ্রবিন্দু এবং সেই সঙ্গে পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও শ্রদ্ধাশীলতার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও প্রধান পুরস্কারের ক্ষেত্রে এ কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। পুরস্কার যেন অবদানের স্বীকৃতি হয়, অন্য বিবেচনার বিকৃতি না হয়।

ড. সেলিম জাহান: জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক