বিশ্বব্যাপী বিস্তীর্ণ একুশ

ঢাকায় অমর একুশের বইমেলা চলছে। বাতাসে বইয়ের গন্ধ। ১৯৮০–র দশকে একুশের বইমেলার পরিসর যখন শুধু বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ও পুকুরপাড় ঘিরে ছিল, তখনো মেলা জমে উঠত। সেখানে মাতোয়ারা থাকতাম সারাক্ষণ। কেউ অটোগ্রাফ চাইলে বর্তে যেতাম। একটি ইংরেজি শব্দও ব্যবহার না করে আড্ডা চালিয়ে যাওয়ার বাজি ধরতাম। আমাদের ঘিরে মানুষ জমে যেত। ইংরেজি ব্যবহারকারীর জরিমানার টাকায় চা-শিঙাড়ার দাম দিতাম। একাডেমির মাঠে বটতলায় স্থির ছবির খোলা প্রদর্শনী হতো। মানুষের পায়ের ঘষায় মাঠের ঘাস নির্মূল হতো না। আমরা ঘাসে বসে সাহিত্য নিয়ে তর্ক করতাম। নিজেদের বের করা লিটল ম্যাগাজিন এক–দুই টাকা দামে বিক্রি করার জন্য তক্কে তক্কে থাকতাম।

এত দিনে আমার লেখালেখির হয়েছে ৫০ বছর। ৩০ বছরই আছি দেশ থেকে বহুদূরে, ইংল্যান্ডে। তবু ৩০ বছরে ৩৮ খানা বইয়ের বেশির ভাগ ওই মেলাতেই প্রকাশিত হয়েছে। এটি ছিল দেশে আমার সাহিত্যিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পবিত্র উপাসনা। ১৯৯০ সালে বিলেতের স্কুলগুলোতে যখন পড়াতে এসেছি, তখন এ দেশে কোনো স্থায়ী শহীদ মিনার ছিল না। এঁরা তখন বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকার কমিউনিটি হলগুলো বুক করতেন। দাওয়াত দিতেন স্থানীয় মেয়র বা কাউন্সিলরকে। আর সে দিনই আগেভাগে গিয়ে কার্ড বোর্ড, আঠা ও ধাতব ফ্রেমের ঠেকা দিয়ে বানাতেন শহীদ মিনার। মঞ্চে স্থিত সে নাজুক মিনারের গোড়ায় সন্ধ্যায় অত্যন্ত সাবধানে প্লাস্টিক প্যাঁচানো ফুলের স্তবক রেখে তার সামনেই শুরু হয়ে যেত আলোচনা অনুষ্ঠান। আলোচনার পর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মায়ের শাড়ি আর বাবার লুঙ্গি পরে গান ধরত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...’। মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদির ভাইয়ের অনুরোধে ১৯৯২ সালে ক্যামডেন এলাকার সুরমা সেন্টারে অতিথি হয়ে আলোচনায় গিয়ে আপ্লুত হয়েছি। দেখেছি কীভাবে মা–বাবারা ট্রেনে, পাতালরেলে করে ফেব্রুয়ারির শীত উপেক্ষা করে প্র্যামে ছোট বাচ্চাটিকে পেঁচিয়ে বড়টির হাত ধরে এসেছেন। কেউ কেউ বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছেন। মনে হয়েছে আমি দেখছি অপ্রতিরোধ্য অভিবাসী বাঙালির জ্ঞাতিকে। আমার চোখ ভরে জল এসেছে।

তারপর একদিন আমারই চোখের সামনে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস আলতাব আলী পার্কে ও ম্যানচেস্টারে ইঞ্চি ইঞ্চি করে গড়ে উঠেছে কংক্রিটের স্থায়ী মিনার। মধ্যরাতে পাড়াপড়শির ঘুম ভাঙিয়ে রাজনৈতিক স্লোগান আর আগে মঞ্চে ওঠার প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মীরা ভয়ে পেছনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসব দেখে একটু বড় হওয়ার পর আর আসে না। আমাদের এই বালখিল্য আচরণে বছর দুয়েক হলো তার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে বাধ্য হয়েছে কাউন্সিলর।

কিন্তু কাজের মানুষেরা কাজ চালিয়ে গেছে এই বহির্বিশ্বে এসেও। দিকে দিকে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শহীদ মিনার। আর একদিন কানাডীয় বাংলাদেশিদের উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে গেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সরকার সে উদ্যোগকে ইউনেসকোর দ্বারে নিয়ে গেলে এল তার স্বীকৃতি। আমার কাজ বাড়ল। তখন থেকে আমি আর নিয়মিত বাংলাদেশের বইমেলায় যেতে পারি না। একবার দেশে যাই তো আরেকবার লন্ডনে থাকি। গত সাত-আট বছর আয়োজন করতে হচ্ছে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলা, যার ব্যাপ্তি বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন ভাষাভাষীর সম্মিলনে ও অংশগ্রহণে ভাষা দিবস এখন এক অনন্য উৎসব হয়ে উঠেছে। বাইরের দুনিয়ায় বাংলা ভাষা ও তার কারবারি বলে পৌরোহিত্য পেয়ে যাচ্ছি আমরাই। একদিন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি বিলেতের এতগুলো ভিনভাষী জ্ঞানী মানুষের মধ্যে আমার স্থান ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে সুযোগে এখানকার বইমেলা, কবিতা উৎসব, আলোচনা অনুষ্ঠান, টিভি-রেডিও ছাপিয়ে আমি পৌঁছে গেছি এমনকি বিবিসি পর্যন্ত। উপস্থাপক আমার কণ্ঠে শুনতে চাইছেন আমার মূল বাংলা কবিতার সঙ্গে তার অনুবাদ অথবা ইংরেজি কবিতার বাংলা অনুবাদ। দর্শক শুনতে চান, যে দেশের মানুষ মায়ের ভাষার জন্য শহীদ হয়ে যায়, সে ভাষা শুনতে কেমন।

এবার দেশে যাওয়ার বদলে যাচ্ছি আমেরিকার ফ্লোরিডা ও নিউইয়র্ক শহরের বইমেলা, শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপনে। সেখানে কবিতা পড়ব, গল্প বলব, বক্তৃতা দেব। দেশান্তরি হলে জন্মভূমি দেশ তার পিঠে কোনো দায় তুলে দেয় না। কিন্তু দায় আপনা-আপনি এসে যায়। বাইরের দুনিয়ায় পাওয়া প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগাতে হয়। এ দায় শুধু বাংলাদেশ দূতাবাসের নয়। এ দায় পরিযায়ী সব পাখির সমান। দেশে রয়েছে সহস্রজন। আর বিদেশে দেশ-মুখ ধরে রাখার উজ্জ্বল সুযোগ পায় গুটিকয়েকজন। মূল ভূখণ্ডের অর্জনেই আসে এমন সুযোগ। কিন্তু তার বিস্তারের ভার আমাদের হাতে।

শামীম আজাদ কবি, গদ্যকার ও কলামিস্ট