বইমেলার কয়েকটি মজার ঘটনা

অনেকেই দল বেঁধে বইমেলায় এসেছেন।ছবি: আবদুস সালাম
অনেকেই দল বেঁধে বইমেলায় এসেছেন।ছবি: আবদুস সালাম

শুক্রবারের এই কলামটা, যার নাম গদ্যকার্টুন, আমি লিখি খানিকটা মজা করার জন্য। আমাদের দিনরাতগুলো বড় বিমর্ষ। রাস্তায় অনড় যানজট, বাতাসে সিসা, পানিতে আর্সেনিক, দুধ, দই, ফলেও নাকি কী কী সব আছে। আমাদের রাজনীতিতে পলিটিকস, আর্থিক খাতে নানা কেলেঙ্কারি, ঋণখেলাপি, টাকা পাচার, কত কিছু! এসব নিয়ে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় কত বর্ণনা, আমাদের টক শোগুলোয় কত উত্তেজনা! সেসবের বাইরে গিয়ে একটু হাসি-মশকরা, হালকা কথা বলার জন্যই আমার এই পাক্ষিক কলাম। এর প্রধান উদ্দেশ্য আমাদের গম্ভীর মুখটায় একটুখানি হাসি ফোটানো। যদিও জানি, লোকে বলতে পারে, দোহাই, লোক হাসাবেন না।

আজ একুশের বইমেলায় ঘটে যাওয়া কয়েকটি মজার ঘটনা বলব।
১. এক নম্বরটা বলছি ওই কথাটা ধরেই, দোহাই, লোক হাসাবেন না। আমি তখন ভোরের কাগজ–এ কাজ করি। শেষ পৃষ্ঠায় লিখি ‘বইমেলা প্রতিদিন’। আমাকে একজন লেখক বললেন, ‘আমার বইটা ১৮০০ কপি বিক্রি হয়েছে।’ আমি লিখে দিলাম: অমুক বলেছেন, অমুক নামের তাঁর নতুন বইটির ১৮০০ কপি বিক্রি হয়েছে। তিনি পরের দিন আমাকে ধরলেন, পারলে মার দেবেন। বললেন, ‘আপনি এ কথা লিখেছেন?’ আমি বললাম, ‘আপনিই তো বললেন।’ ওই লেখক বললেন, ‘আমি বললেই হলো? কোনো লেখক কেন এটা বলবে? এটা বলবে প্রকাশক। আপনার উচিত ছিল, প্রকাশকের বরাত দিয়ে যে প্রকাশক জানিয়েছেন তাঁর অমুক লেখকের অমুক বইয়ের ১৮০০ কপি বিক্রি হয়ে গেছে। দুই দিন পরে তিনি একটা পত্রিকায় আমার একটা সাক্ষাৎকার ছাপালেন। আমার পরিচয় দিলেন, আনিসুল হক কৌতুক-লেখক।
অপূর্ব প্রতিশোধ!

২. ১৯৮০–এর দশকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা। পুকুরপাড়ে একটা স্টল ছিল, ‘পাণ্ডুলিপি’। তাতে লেখা ছিল: এখানে কবি নির্মলেন্দু গুণ পাওয়া যায়। এক পাঠক রসিকতা করে বললেন, ‘কত করে সের?’

৩. সরদার জয়েনউদ্দীন নারায়ণগঞ্জে প্রথম বইমেলার আয়োজন করেন। সেটা বোধ হয় স্বাধীনতার আগে। সেখানে একটা গরু বেঁধে রাখা হয়েছিল। তার গায়ে লেখা ছিল, ‘আমি বই পড়ি না।’

৪. কবি মহাদেব সাহা একবার একটা বই লিখলেন: আমি ছিন্নভিন্ন। ওই বছরেই নির্মলেন্দু গুণ বই লিখলেন: দুঃখ কোরো না, বাঁচো। আমরা মহাদেব সাহার ছেলে তীর্থ সাহাকে বললাম, ‘দেখলা, তোমার বাবা আর কাকু বইয়ের নাম কী দিয়েছেন?’ তীর্থ তখন হয়তো বছর আটেকের। গম্ভীর মুখে বলল, ‘পড়ে দেখেন, ঠিকই আছে।’

৫. হুমায়ুন আজাদ নারী বই বের করবেন। বের হতে দেরি হচ্ছে। বেশ কদিন পরে মেলায় বই এল। তা–ও আবার প্রচ্ছদ ছাড়া। তা–ও বিক্রি হয়ে যেত লাগল। আমি তাঁকে বললাম, ‘স্যার, আপনার বই তো প্রচ্ছদ ছাড়াই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘নারী তো প্রচ্ছদ ছাড়াই ভালো।’ তিনি রসিকতা করেছিলেন, আমি ছিলাম অতি তরুণ, সেটা কাগজে লিখে দিলাম। তিনি ভীষণ রাগ করেছিলেন। এটা কেন কাগজে লিখে দিয়েছ। কোনো কিছু লিখতে হলে অবশ্যই তা আগে থেকে জানাতে হবে যে এটা আমি প্রকাশ করব।

৬. বইমেলার ভেতরে মজার ঘটনাই পাচ্ছি না। বইমেলার বাইরের কথা বলি। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুষ্ঠানে নেলসন ম্যান্ডেলা এসেছিলেন, ইয়াসির আরাফাত এসেছিলেন। অনেক মানুষ এসেছে তাঁদের দেখতে, পারলে অটোগ্রাফ নিতে। ভিআইপিদের কাছে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নির্মলেন্দু গুণ অনুষ্ঠান শেষে ফিরছেন। লোকজন তাঁকে ঘিরে ধরেছে, ‘দ্যান, একটা।’ নির্মলেন্দু গুণ অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। একজন তাঁর অটোগ্রাফ নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি যে আপনার অটোগ্রাফ নিলাম, কিন্তু আপনি করেনটা কী?’
‘মানে?’ গুণদা জানতে চাইলেন। অটোগ্রাফশিকারি বলল, ‘আপনে ক্রিকেট খেলেন? না ব্যান্ডের গান করেন?’

৭. এই গল্পটা বলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। একবার এক লোক সিলেটে তাঁর কাছে গেল। বলল, ‘আমি বহু কষ্ট করে আপনার কাছে বহুদূর থেকে এসেছি। আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি?’
মুহম্মদ জাফর ইকবাল বললেন, ‘জি, ধরুন।’
লোকটা স্যারের হাত ধরে আবেগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এটা কি সত্যি যে আপনি হুমায়ূন আহমেদের ভাই?’

৮. আমার বেলায় এটা অনেকবার হয়েছে। দৌড়ে এসেছে বাচ্চারা আমার কাছে। অটোগ্রাফ দিন। ফটো তুলি! তারপর বলবে, স্যার, আপনার দীপু নাম্বার টু জোশ ছিল। রাশা খুব ভালো লেগেছে। শান্তা পরিবার কিংবা আমার বন্ধু রাশেদ–এর মতো আর লেখেন না কেন! আমি বলি, আমি তো মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার নই, আমি আনিসুল হক। তখন বলে, দুরো, আগে বলবেন না? আমি তাই এখন আগে থেকেই বলে নিই, জানো তো যে আমি মুহম্মদ জাফর ইকবাল নই। তবে জাফর ইকবাল স্যার বলেছেন, একবার নাকি উল্টোটাও হয়েছে। তাঁর অটোগ্রাফ নেওয়ার পরে বলেছে, আপনি আনিসুল হক না? আমার ধারণা, স্যার আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এটা বানিয়ে বলেছেন।

৯. হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কোনো বইমেলার গল্প না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে কোনো মজার গল্প এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে দুঃখের গল্প। স্যার চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্ক যাবেন। তাঁকে বললাম, ‘স্যার, আপনার অন্তত আরও ১০ বছর বাঁচা দরকার। আমাদের বইমেলা, টিভি নাটক, সিনেমার জন্য। আপনি ১০ বছর লিখে গেলে সব দাঁড়িয়ে যাবে, তারপর আমরা পারব।’
তিনি বললেন, ‘চাইছ যখন ১০ বছর কেন? ১ হাজার বছর চাও।’
নিউইয়র্ক থেকে আমাকে কৌতুকের বই পাঠালেন, লিখে দিলেন, আনিসুল হক, ‘তোমার কৌতুকগুলো পানসে হয়ে যাচ্ছে, ফরেন এইড নাও।’
নিউইয়র্ক থেকে প্রায় সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন। ঘেটুপুত্র কমলার প্রদর্শনী করলেন। আমরা একসঙ্গে লিফটে স্টার সিনেপ্লেক্সে উঠলাম। আমাকেও বক্তৃতা দিতে হলো সেই অনুষ্ঠানে।
তারপর আবার গেলেন নিউইয়র্ক। আর ফিরলেন না।

আনিসুল হক : প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক