বিজিবির গুলি

ঠাকুরগাঁওয়ে বিজিবির সদস্যদের গুলিতে ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া এক শিশুসহ তিনজনের নিহত হওয়ার ঘটনা যেমন দুঃখজনক, তেমনই নিন্দনীয়। বিজিবি গুলি চালানোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছে, ভারত থেকে চোরাচালান হয়ে আসা গরু ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের বেতনা গ্রামের এক বাড়ি থেকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় বাসিন্দারা গরু ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেন এবং তঁাদের ওপর আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার জন্য তাঁরা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু গ্রামবাসী বলেছেন, বিজিবির সদস্যরা স্থানীয় এক বাসিন্দার বাড়ি থেকে দেশি গরু চোরাচালানের বলে ভটভটিতে করে নিয়ে যান। এতে স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে গরু নিয়ে যেতে বাধা দেন। ঘটনার পর থেকে গ্রামবাসী বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছেন।

প্রথমে যে প্রশ্নটি আসে তা হলো গরুগুলো যদি চোরাচালান হয়ে এসে থাকে, বিজিবি সদস্যরা কেন তা সীমান্তেই আটক করলেন না। তাঁদের দায়িত্ব সীমান্ত নিশ্ছিদ্র রাখা, যেন সে পথে কেউ অবৈধভাবে কোনো কিছু আনতে বা নিয়ে যেতে না পারে। কোনো নাগরিকের বাড়িতে ঢুকে গরু বা অন্য কিছু নিয়ে যাওয়া সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ নয়। সীমান্তে দায়িত্ব পালন না করে গ্রামে গ্রামে গরু খুঁজে বেড়ানো বিজিবির কাজ নয়। তারপরও যদি তাঁদের কাছে অকাট্য প্রমাণ থাকে, তাহলে উচিত ছিল থানা-পুলিশের সহায়তা নেওয়া। দেশের অভ্যন্তরে অপরাধী ধরা বা মালামাল জব্দ করার দায়িত্ব পুলিশের। একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্য হয়েও কেন তাঁরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে গেলেন? শিশুসহ যে তিনজন নিরপরাধ মানুষ মারা গেল, তার দায় কে নেবে?

স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, চোরাচালানের গরু আটক করতে, না অন্য কোনো কারণে বিজিবির সদস্যরা গ্রামে গিয়েছিলেন? তঁারা আইনের পথে না গিয়ে জোর করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বাড়ি থেকে গরু নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে গ্রামবাসী তাঁদের বাধা দিয়েছেন। অনেক সময় দেখা যায় চোরাচালানিদের সঙ্গে বিজিবির সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে থাকে। সেই বোঝাপড়া যত দিন ঠিক থাকে, তত দিন সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পণ্য আনা-নেওয়ায় কোনো সমস্যা হয় না। বেতনা গ্রামের ঘটনায়ও সে রকম কিছু ঘটেছিল কি না, তদন্তের দাবি রাখে।

কথিত গরু চোরাচালানের ঘটনা নিয়ে যে তিনজন নিরীহ মানুষ মারা গেল, তার জবাব কী। স্থানীয় দিনমজুরের সন্তান শিশুটি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। মা তাকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। বিজিবি কি বলবে ওই শিশুটিও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিল? গুলিতে নিহত আরেকজন হলেন কৃষক সাদেক। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে তিনি হাটে গিয়েছিলেন গরু বিক্রি করতে। এখন দুজনই এলেন লাশ হয়ে। এদের স্বজনদের কাছে কী কৈফিয়ত দেবেন আমাদের সীমান্ত রক্ষার অতন্দ্র প্রহরীরা?

গরুগুলো চোরাচালানের কি না, তা নিশ্চিত নয়। গ্রামবাসীর দাবি অনুযায়ী গরুগুলো দেশীয় হলে আটক করা সম্পূর্ণ বেআইনি। আর চোরাচালানের গরু হলেও বিজিবির সদস্যরা নিজেরা সেখানে না গিয়ে পুলিশকে জানালে পুলিশ আইনানুগ পদক্ষেপ নিত। তাহলে গুলি করে তিনজন মানুষ হত্যার মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটত না।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে বাংলাদেশের মানুষ মারা যেত। বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে সীমান্তে বিএসএফের হত্যা কিছুটা কমেছে। কিন্তু এবার আমাদেরই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা এ রকম গুলি চালিয়ে এ দেশের তিনজন মানুষকে হত্যা করলেন! এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হোক। সেই সঙ্গে নিহত তিনজনের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানাই, যদিও মানুষের মৃত্যুর ফলে যে ক্ষতি তা পূরণ হওয়ার নয়।