বিদায় আল মাহমুদ

‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে/ মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ/ অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ’। কোনো এক শুক্রবার যদি মৃত্যু এসে ‘যাওয়ার তাকিদ’ দেয় তাহলে সেই মৃত্যুকে তিনি ‘ঈদ’ হিসেবে সানন্দে গ্রহণ করবেন। গত শুক্রবার মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে তাঁরে।

১৯৩৬ সালে জন্ম নিয়েছিলেন মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। সেই তিনি সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ হিসেবে এই ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার মৃত্যুবরণ করলেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর জাগতিক ব্যক্তিসত্তার অবসান কিংবা বলা যায় চূড়ান্ত পরিণতি হলো। সেদিক থেকে তাঁর লৌকিক বয়স দাঁড়াল ৮৩ বছর। কিন্তু গত কয়েক দশকে তাঁর কবিসত্তার যে শৈল্পিক বিস্তার ঘটেছে, তার শিগগির অবসানের শঙ্কা নেই। তাঁর সৃষ্টিকর্ম যে কালোত্তীর্ণ হয়ে রয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।

আল মাহমুদের অমর কাব্যগ্রন্থ সোনালী কাবিন সমকালীন বাংলা কবিতার একটি বাঁকের নাম। বলা হয়ে থাকে, তিনি যদি শুধু এই একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতেন, তাতেও বাংলা কবিতার রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে থাকতেন। কবি পরিচয়টি আল মাহমুদের ‘ট্রেডমার্ক’ হলেও তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তবে তাঁর কাব্য প্রতিভার কাছে অন্য সব পরিচয় ফিকে হয়ে যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে সমৃদ্ধ করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি পত্রিকার প্রুফরিডার থেকে নিজেকে জাতীয় দৈনিকের প্রধান সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

একটি সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছিলেন, বাংলাদেশের বহু নদীর পানি স্বর্গীয় পীযূষজ্ঞানে আক্ষরিক অর্থেই হাতের আঁজলায় ভরে তিনি পান করেছেন। তাঁর এই মৃত্তিকাবর্তী মোহনীয় মানস তাঁর কবিতার মধ্যেও দেখা যায়। আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেও তিনি ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে কবিতায় অবলম্বন করেছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তাঁর অনন্য কীর্তি। তাঁর জাদু স্পর্শে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য পঙ্‌ক্তিমালা। যে মৃত্যু তাঁকে নিয়ে গেল, সেই মৃত্যু নিয়ে ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায় তিনি লিখে গেছেন: ‘প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ/ মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস/ যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন/ তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।’

এই কবির মৃত্যু যেন মৃত্যু নয়। এ যেন অমৃতের পথে মহাপ্রয়াণ। সেই অনন্ত যাত্রার যাত্রী, প্রয়াত কবির প্রতি শ্রদ্ধা।