স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোনো দল টেকেনি

আবদুর রাজ্জাক, গতকাল লন্ডনে
আবদুর রাজ্জাক, গতকাল লন্ডনে

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া ও দল বিলুপ্তির প্রশ্নে জামায়াতে মতবিরোধ আবারও সামনে এসেছে। কয়েক দিন ধরেই জামায়াত নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনার মধ্যে শুক্রবার পদত্যাগ করেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক। এ নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন। লন্ডনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদ।


প্রথম আলো: আপনি জামায়াতে ইসলামীতে যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন, তার একটা বিষয় ছিল ’৭১-এ দলের ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া, আর অন্যটি দলের রাজনৈতিক ভাবাদর্শে পরিবর্তন। আপনি সামাজিক ন্যায়বিচারের রাজনীতির কথা বলেছেন। তো এই দুইয়ের মধ্যে কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
আবদুর রাজ্জাক: আমার মনে হয় দুটোই। কিন্তু আমি খুব খোলামেলাভাবেই বলব যে, ’৭১-এর জামায়াত দেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। জামায়াত দেশে ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল। এটা আমাকে বেশি পীড়া দিয়েছে। ’৮১ সালে যে জন্ম নিয়েছে এবং জামায়াতের রাজনীতি করতে চায়, সে কেন জামায়াতের ওই বোঝা বহন করবে? একাত্তরই আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। তা না হলে হয়তো আমি আরও কিছুদিন দলে থেকে সংস্কারের চেষ্টা করতাম। ’৭১-এর বিষয়ে আমি যেটা বলতে পারি সেটা হচ্ছে, একটি দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কেউ সে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন-এ রকম ইতিহাস আমি খুঁজে পাই না। সেটা জর্জ ওয়াশিংটনের কথাই বলেন, আর আমাদের উপমহাদেশের কথাই বলেন, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার ইতিহাস দেখুন।

প্রথম আলো: আপনি জামায়াতের রাজনীতি করছেন ৩০ বছর ধরে। তাহলে স্বাধীনতার পর আপনি জামায়াতে কেন যোগ দিলেন?
আবদুর রাজ্জাক: আসলে আমি তো একজন মুসলিম ডেমোক্র্যাট এবং ইসলামি মূল্যবোধ যেটা আমি তো মনে করি সেটিই সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ। যদিও আমি মনে করি, ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর মধ্যেই ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। সুতরাং, এই মূল্যবোধের প্রসার ঘটানোর জন্যই আমি মনে করেছিলাম যে জামায়াত উপযুক্ত ফোরাম।

স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোনো দল টিকতে পারে না বা সে দেশের নেতৃত্ব দিতে পারে না।

প্রথম আলো: তখন জামায়াতে যোগ দেওয়ার সময়ে আপনার মনে হয়নি যে দলটির ’৭১-এর দায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে?
আবদুর রাজ্জাক: ওই সময় এটি কোনো বাধা ছিল না। ’৮৬-তে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন করেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ’৮৬-র নির্বাচনে বিএনপি আসেনি। কিন্তু, জামায়াত আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অংশ নিয়েছে। তখন বিষয়টা বড় হয়ে ওঠেনি। ’৯০-তে আমার মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয় যে ’৭১-এর বিষয়টি নিয়ে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। ’৯০ সালে আমি চীনে এক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানে পাকিস্তান থেকে গিয়েছিলেন দেশটির প্রধান বিচারপতি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেশটির বিচারপতি নাসিম হাসান শাহ। তাঁরা ফেরার পথে ঢাকা হয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকায় তখন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন ড. কামাল হোসেন এবং প্রধান বিচারপতি ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। পাকিস্তানের বিচারপতিরা ছিলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। তো সেখান থেকে বিচারপতি নাসিম হাসান শাহ আমাকে ফোনে ডাকলেন। উদীয়মান আইনজীবী হিসেবে তাঁরা আমাকে বেশ সম্মান দিয়েছিলেন। বিচারপতি শাহ আমাকে বললেন, দল হিসেবে ’৭১-এর বিষয়টির যদি সুরাহা না করতে পারো, তাহলে জামায়াত বেশি দূর এগোতে পারবে না।

২০০১ সালে ক্ষমা চাইতে বলি
প্রথম আলো: তখন থেকে ২০১৯-এই সময়ের মধ্যে আপনি পাঁচটি সময় উল্লেখ করেছেন; ২০০১, ২০০৫, ২০০৭-০৮, ২০১১ এবং ২০১৬, যখন আপনি লিখিতভাবে সংস্কারের কথা বলেছেন। এত দীর্ঘ সময় কেন অপেক্ষা করলেন?
আবদুর রাজ্জাক: ১৯৯৪ সালে যখন গোলাম আযম সাহেবের নাগরিকত্বের বিষয়টি সমাধান হয়ে গেল, তখনই আমি মত দিই যে আমাদের মাফ চাওয়া উচিত।

প্রথম আলো: ব্যক্তিগতভাবে আপনি সরাসরি বলেছিলেন?
আবদুর রাজ্জাক: আমি ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-আলোচনায় তুলেছি। তবে, আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে তখন নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি, যেটা ২০০১ সালে বলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের সহায়তা নিয়েছিলাম, যাঁদের দুজন এখনো জীবিত আছেন। আমি লিখিতভাবে খসড়া বিবৃতি তৈরি করে দিয়েছিলাম। সে বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সেটি হবে বলে আশা করেছিলাম।