শামীম ওসমানের 'সত্যভাষণ' ও ত্বকী হত্যার বিচার

শামীম ওসমান বলেননি যে এই নারায়ণগঞ্জেই ছয় বছর আগে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী নামে এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়েছে।
শামীম ওসমান বলেননি যে এই নারায়ণগঞ্জেই ছয় বছর আগে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী নামে এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়েছে।

শামীম ওসমানকে ধন্যবাদ তাঁর আংশিক সত্যভাষণের জন্য। প্রশাসন নিয়ে এ রকম নির্ভেজাল সত্যভাষণ অতি সম্প্রতি সরকারি দলের কোনো সাংসদের মুখে শোনা যায়নি।

গতকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় ও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান যা বলছেন, তাতে হতাশা ও বেদনার সুর আছে।

বেদনার কারণ সম্ভবত এখন প্রশাসন জনপ্রতিনিধিদের আগের মতো পাত্তা দেয় না। তাঁর ভাষায়, ‘প্রশাসন এখন মনে করছে তারা জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে অনেক ওপরে উঠে গেছে। তাঁরা অনেকেই নিজেকে জনপ্রতিনিধিদের চেয়েও অনেক বেশি পাওয়ারফুল পারসন (ক্ষমতাধর ব্যক্তি) মনে করেন।’

এর মাধ্যমে শামীম ওসমান যে কথাটি বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো, আগে প্রশাসনের কর্মকর্তারা জনপ্রতিনিধিদের কথা শুনতেন। এখন তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের পাত্তা দেন না। জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করেন। এটি কি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া কি না, সে কথা তিনি ভেঙে বলেননি।

শামীম ওসমান এ কথাও স্পষ্ট করেননি যে কখন থেকে প্রশাসনের লোকজন নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করতে শুরু করলেন? তবে তাঁর ‘এখন’ শব্দ ব্যবহারটি বেশ অর্থপূর্ণ। আগে প্রশাসন জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবত না। এখন ভাবছে। জনপ্রতিনিধিদের কোন দুর্বলতার কারণে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবছেন, সেটি শামীম ওসমান ভালো করেই জানেন। কিন্তু সেটি তিনি বলবেন না। বললে ইজ্জত থাকে না।

দেশে প্রশাসন ও আইনকানুন ঠিকমতো চললে তো কেউ কাউকে ক্ষমতা দেখানোর প্রশ্ন আসে না। প্রশাসন নিজস্ব আইনে চলবে। জনপ্রতিনিধিরাও তাঁদের নিজ নিজ কার্যসীমা মানবেন। জনপ্রতিনিধিরা যেসব আইন করবেন, সেটা বাস্তবায়ন করবে প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘তবে প্রশাসন তোমার মালিক না। তোমার করের টাকায় প্রশাসন লালিত-পালিত হয়।’ শামীম ওসমানের অজানা নয়, জনগণের করের টাকায় শুধু প্রশাসন চলে না, মন্ত্রী-এমপিরাও জনগণের করের টাকায় চলেন। কোথায় কোন জনপ্রতিনিধি গডফাদারের তকমা পান, সেটিও জনগণ জানেন।

বাংলাদেশে এখন প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবাই ক্ষমতাবান। শুধু জনগণই ক্ষমতাহারা।

ওই অনুষ্ঠানে শামীম ওসমান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে যা বলেছেন, তা আরও বেশি কৌতুককর। তিনি বলেছেন ‘প্রশাসনের দায়িত্ব আছে। তাই ছাত্রসমাজ চুপ থাকার কারণে আজ দেশে শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, ছাত্রীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজাকার-আলবদররা দেশকে ধমক দেয়। তাই আমি চাই দেশের পক্ষে কথা বলার জন্য কিছু যোগ্য নাগরিক সৃষ্টি হোক। তোমরা নিজেদের যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে দেশের দায়িত্ব নাও।’

শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর উপদেশ, ‘আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। প্রতিবাদ করার লোক আমি নারায়ণগঞ্জে পাচ্ছি না। তাই সকল অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে তোমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, সরকারি তোলারাম কলেজের ছাত্ররা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে নারায়ণগঞ্জে মাদক, ইভ টিজিং, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি কোনো কিছুই থাকবে না।’

শামীম ওসমানের এই কথাটি বিশ্লেষণ করলে আমরা কী পাই। প্রথমত, তাঁর সময় শেষ হয়ে আসছে । ফলে এখন শিক্ষার্থীদের সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, তার প্রতিবাদ করতে হবে। ছাত্রীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তার প্রতিবাদ করতে হবে। নারায়ণগঞ্জে যে অন্যায়-অবিচার হচ্ছে, তার প্রতিবাদ করতে হবে। কিন্তু তিনি বলেননি যে এই নারায়ণগঞ্জেই ছয় বছর আগে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী নামে এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়েছে। ১৬ বছরের মেধাবী ছেলেটি ও-লেভেল পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে সারা বিশ্বে রেকর্ড নম্বর পেয়েছিল। ত্বকী হত্যার বিচার আজও হয়নি। আটক দুই আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পরও মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়নি।

যেই শিক্ষার্থীদের শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে বলেছেন, সেই শিক্ষার্থীরা যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করে, কেন শিক্ষক শ্যামল কান্তির লাঞ্ছনাকারীর বিচার হলো না, কেন ত্বকী হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করেও ছেড়ে দেওয়া হলো, তিনি কী জবাব দেবেন?

শামীম ওসমান বলেছেন নারায়ণগঞ্জে প্রতিবাদ করার মানুষ পাচ্ছেন না। তাঁর এই কথাটি সম্পূর্ণ অসত্য। নারায়ণগঞ্জে যে প্রতিবাদ করার মানুষ আছে, সেটা প্রমাণিত হয়েছে সাত খুনের ঘটনায়। সাখাওয়াত হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধা আইনজীবীদের আইনি লড়াইয়ের ফলেই সাত খুনের বিচার হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে যে প্রতিবাদ করার মানুষ আছে, সেটি প্রমাণ করেছেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ফুটপাত দখলমুক্ত করতে গিয়ে মাস্তানদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে। নারায়ণগঞ্জে যে প্রতিবাদ করার মানুষ আছে, তা প্রমাণ করেছে ত্বকী বিচার মঞ্চ। ছয় বছর ধরে তারা বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছে। যত দিন বিচার না হবে, তত দিন তারা আন্দোলন করে যাবে।

আর এই বিচারের মাধ্যমেই হয়তো প্রমাণিত হবে কারা নারায়ণগঞ্জের নায়ক আর কারা খলনায়ক।