ড. জোহা কি আর জন্মাবেন?

শহীদ অধ্যাপক ড. শামসোজ্জোহা
শহীদ অধ্যাপক ড. শামসোজ্জোহা

ছাত্রছাত্রীদের প্রতি একজন শিক্ষকের কতটুকু দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থাকা উচিত, ড. জোহা জীবন দিয়ে সেটি নির্ধারণ করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।’ তিনি নিজের জীবন দিয়ে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে আত্মদানকারী প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা, যাঁর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের দাবানল সারা দেশে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৯৬১ সালে ড. শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন এবং পরের বছরেই তিনি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে লন্ডনের বিখ্যাত ইমপেরিয়াল কলেজে যান। তিনি ১৯৬৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৬ সালে রিডার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করলে ছাত্র-শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষই অনুধাবন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতার বীজ বপন করলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে। এ সময় ড. শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৬৬-১৯৬৮, তত দিনে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলায় গণ-আন্দোলন শুরু হয়। এমন একটি আবহে ড. জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হলে তাঁদের হত্যার প্রতিবাদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। একই দাবিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল বের করলে ড. জোহা ছাত্রদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনেন এবং আহত ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই দিন রাতে শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা বলেছিলেন, ‘শুধু ছাত্ররা নয়, আমরা সবাই মিলে এই দানবীয় শক্তিকে রুখে দাঁড়াব, মরতে যদি হয় আমরা সবাই মরব।’ ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মিছিল নিয়ে শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ, ইপিআর, সেনাবাহিনী ও ছাত্ররা মুখোমুখি অবস্থানে। ড. জোহা একদিকে ছাত্রদের শান্ত করছিলেন, অন্যদিকে সেনা কর্মকর্তাদের বোঝাচ্ছিলেন আর বারবার বলছিলেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার। আমার ছাত্ররা এখনই ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে।’ একপর্যায়ে ছাত্রদের বোঝাতে সক্ষম হন, ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ফিরতে শুরু করেন। পরিস্থিতি যখন শান্ত, ঠিক তখনই গুলির শব্দ। ড. জোহাকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয় এবং বেয়নেট চার্জ করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। দীর্ঘ সময় পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, ততক্ষণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, যার ফলে ড. দত্ত অনেক চেষ্টা করেও ড. জোহাকে বাঁচাতে পারেননি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ ড. শামসুজ্জোহার জন্য নিবেদিত স্মতিফলক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ ড. শামসুজ্জোহার জন্য নিবেদিত স্মতিফলক

ড. শামসুজ্জোহা শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও অনেক সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। ছাত্র-অন্তপ্রাণ শিক্ষক ড. জোহা সর্বদাই ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল, অত্যন্ত মিশুক ও অমায়িক। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো এবং অভিভাবকসুলভ।
এই মহান শহীদ বুদ্ধিজীবী ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং শিক্ষাজীবনের সব ক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরবর্তী সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। উনসত্তরের এই সাহসিক আত্মত্যাগ তাঁর সংগ্রামী বিবেক এবং শিক্ষকসুলভ দায়িত্ববোধেরই পরিচয় দেয়।
ড. জোহার এই আত্মত্যাগ নিশ্চয় অভিধানে নতুন শব্দের সংযোজন করে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের মানুষের অহংকার, তরুণ প্রজন্মের কাছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধসম্পন্ন একজন শিক্ষক, একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। ড. জোহা যুগে যুগে শিক্ষক সমাজের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জোহা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে এবং দিবসটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিনীত আবেদন জানাচ্ছি।

ড. জোহা আর জন্মাবেন না, তাঁর মতো আত্মত্যাগী শিক্ষক আজ আর কোথায়? কিন্তু প্রেরণাটুকু বেঁচে থাক।

লেখকদ্বয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাক্রমে হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগ এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।