জামায়াতে সংস্কার কী ফল দেবে

আমাদের স্কুলজীবনে পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণ করতে বলা হতো, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। যে যেমন, সে সেখানেই মানানসই। বনের পশুপাখি খাঁচার চেয়ে বনভূমিতেই সুন্দর ও শোভন। যেমন মায়ের কোলে শিশু। সমাজ ও রাষ্ট্রেও চরিত্রগত দিক দিয়ে যারা যা, নীতিতে ও স্বভাবে যারা যেমন, যথাস্থানেই তারা ভালো। ছদ্মবেশ পরে যদি তারা ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়, মানুষ তাতে প্রতারিত হতে বাধ্য।

কোনো জাতির প্রধান ও মূলধারার রাজনীতি যদি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, তার গৌণ ও উপধারা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারে না। যেমন, যে মানুষের শরীরে বায়োপসি রিপোর্টে কার্সিনোমার উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে লিখেছে, তার ডান পায়ের হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত সুস্থ বলা যায় না। যখন দেশের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বড় দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক নয়, সেখানে অপ্রধান ও গণধিক্কৃত কোনো দল আস্ত থাকল কি খণ্ডবিখণ্ড হলো, অথবা নীতি ও আদর্শ বদলাল, তাতে দেশের ও দশের কিছুই যায়–আসে না।

যে জামায়াতে ইসলামীকে লোকে ভুলে গিয়েছিল, তার এক পরবাসী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের পদত্যাগপত্রে সেই দল আবার সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হওয়া কম ভাগ্যের কথা নয়। তিনি পদত্যাগ করে জীবন্মৃত দলটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। যে দেশে রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা প্রধান এবং দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় দলের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেন না, তাঁরা ওই গৌণ দলের ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উতলা হয়ে পড়েছেন।

বঙ্গের বুদ্ধিমানেরা বলেন, বেকায়দায় পড়লে বাঘেও ঘাস খায়। কোনো দলও যখন তার দুঃসময়ে গভীর সংকটের আবর্তে পড়ে, তখন তার বুদ্ধিমান নেতারা বাঘের মতো ঘাস খান না বটে, আত্মরক্ষার জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নেন। কেউ অসুস্থতার অজুহাতে নিষ্ক্রিয় থাকেন, কেউ পরবাসে পাড়ি জমান, কেউ সুবিধামতো কোনো দলে যোগ দেন। গত নির্বাচনের আগে যেমন বিএনপির এক নেতা কুড়ি দিন পরে প্রজাতন্ত্রে কী হতে যাচ্ছে তা অবগত হওয়ার পর ফুলের তোড়া নিয়ে অন্য দলে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন, যে দলের নীতি-আদর্শকে তিনি দীর্ঘদিন সমালোচনা করেছেন। প্রধান ধারার রাজনীতিতে যখন অমনটি হয়, গৌণ ধারায় তা আরও বেশি প্রকট হওয়ার আশঙ্কা।

রাজধানীতে প্রতি রাতের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রহরে যাঁরা মৌখিকভাবে দেশের রাজনীতি নিয়ে উপভোগ্য বিশ্লেষণ করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের ভান্ডার। তবে তাঁরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার চেয়ে নিজেদের দলীয় অবস্থান থেকে বাণী বিতরণ করতেই ভালোবাসেন। পরবাসী জামায়াত নেতার পদত্যাগের চিঠি ঢাকায় পৌঁছার পর সেদিন সন্ধ্যারাতে অনেকের কথাবার্তা শুনে মনে হলো কাজটি বেশ হয়েছে। এখন থেকে বাংলার রাজনীতিতে বইবে সুবাতাস। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতাকারীরা ওরফে পাকিস্তানপন্থীরা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছেন। একাত্তরের রক্তস্রোতের ব্যাপারে অনেকে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছুক।

ওই দিন পদত্যাগপত্র সম্পর্কে গণমাধ্যম থেকে আমার মন্তব্য চাওয়া হয়। প্রশ্নকর্তাকে আমি বলেছিলাম, পদত্যাগপত্রের চেয়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ পদত্যাগপত্র পাঠানোর সময়টি। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, বুঝলাম না, তার মানে? আমি বললাম, তার মানে হলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করলে তিনি পদত্যাগ করতেন কি না?

যে দলটিকে নিয়ে বাংলাদেশের সেক্যুলার প্রগতিশীলেরা দিবানিশি মাথা ঘামাচ্ছেন, তাঁরা শুধু তার একাত্তরের ভূমিকা নিয়েই ভাবছেন। কিন্তু সে তো শুধু একাত্তরেই সীমাবদ্ধ নয়—সে তো প্রসারিত মধ্যযুগ পর্যন্ত। অবিচল পাকিস্তানপন্থী এবং ঘোরতর ভারতবিরোধী দলটি মধ্যপ্রাচ্যপন্থী শুধু নয়, মধ্যযুগপন্থী। এটা আধুনিক গণতন্ত্রের যুগ, কিন্তু দলটি জাগতিক আইনে বিশ্বাস করে না। তা ছাড়া দলটির শিকড় বাংলার মাটিতে নয়—বাংলাদেশে তার শাখা। এটি একটি আন্তর্জাতিক দল, এর শাখাপ্রশাখা বিশ্বের সব মুসলমান অধ্যুষিত দেশে বিস্তারিত। এই দলের কোনো নেতা পদত্যাগ করলে, কোনো নেতাকে বহিষ্কার করা হলে মূল দলের নীতি–আদর্শে হেরফের হয় না।

এর আগে বিএনপির সব রস ষোলো আনা আস্বাদনের পর এক ব্যারিস্টার পদত্যাগ করেন। আমরা মনে করলাম, জিয়া–খালেদার রক্ষণশীল বিএনপি গেল এবং বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলার প্রগতিশীল আওয়ামী লীগের মতো আর একটি বিএনপি বা কাছাকাছি ধরনের নামে দল বাংলার রাজনৈতিক আকাশে আর্বিভাবের অপেক্ষায়। আওয়ামী লীগ নেতারাও অনেকে মনে করলেন—এই বলে তার পরিচয় হোক তিনি আমাদেরই লোক। ব্যারিস্টার নিজেও তাদের লোক হওয়ার বাসনা করেছিলেন, কথাবার্তায় সে বাসনার প্রকাশ ঘটলেও শরীর থেকে সাফারি–স্যুট খুলে মুজিব কোট পরতে পারেননি চক্ষুলজ্জাবশত।

একাত্তরের দুষ্কর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেই দলটির প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র বদলে যাবে, তা মনে করার কোনো কারণই নেই। কারণ, এটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবে কোনো নেতা কোনো ধারণা পোষণ করলেই দলীয় নীতি–আদর্শ বদলে যেতে পারে না। যে দলের মাথার ওপরে মাওলানা মওদুদী রয়েছেন, সেখানে ব্যারিস্টার সাহেবের পরামর্শে কেউ কান দেবেন না। ওই পদত্যাগপত্র ফাইলেই পড়ে থাকবে। সেক্যুলাররা বুঝিয়ে–শুনিয়ে যদি কোনো স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীকে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চান, তা মাঠা বা ঘোল নয়, তা হবে নকল দুধ।

স্বাধীনতার সপক্ষের সেক্যুলার নেতাদের কাছে শুনেছি ব্যারিস্টার রাজ্জাক লোক ভালো। তাঁরা বহুদিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউএনডিপি প্রভৃতির কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের বাসভবনে প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ ও নৈশভোজে একত্রে অংশগ্রহণ করেছেন। সমাজে দূরত্ব রক্ষা করলেও বিদেশি দূতাবাসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের নেতারা জম্পেশ আড্ডা জমিয়েছেন। তার ফলেই রাজনীতি আজ এই গন্তব্যে পৌঁছেছে।

জামায়াতকে আমাদের পশ্চিমি বন্ধুরা উদার বা মডারেট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি মনে করে। তারা নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে চায়। সে জন্য পশ্চিমারা দলটিকে মূল্য দেয়। তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সময় একবার এক পশ্চিমা
কূটনীতিক বলেছিলেন, জামায়াত বর্তমানে ক্ষমতা নিয়ে ব্যাকুল নয়, ২০–২৫ বছর পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। এখন সেই লক্ষ্যেই জামায়াত কাজ করছে।

জামায়াতের নাম ও নীতি বদলে যাঁরা সংস্কার করতে চান, একাত্তরের জন্য ক্ষমা চাইতে আগ্রহী, তাঁদের সদিচ্ছার সমালোচনা যায় না, কিন্তু তাঁদের লক্ষ্যকে সমর্থন করা সম্ভব নয়। তাঁরা চান দলকে তুরস্কের একে পার্টি বা তিউনিসিয়ার এন্নাহাদার মতো অথবা মিসরের ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির মতো কিছু করে মুসলমান ভোটারদের সমর্থন আদায় করবেন। ওই সব দেশ ইউরোপের মোটামুটি কাছে। বাংলাদেশ বঙ্গীয় বদ্বীপ। পঁচাত্তরের পরে জামায়াতের নেতারা মাওলানা আবদুর রহীমের নেতৃত্বে ইসলামিক ডেমোক্রটিক লিগ করেছিলেন এবং ১৯৭৯-তে দ্বিতীয় সংসদে ২০টি আসনও বাগিয়ে নেন। তাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কী উপকারটা হয়েছিল।

যারা যা তাদের তা–ই থাকতে দেওয়া ভালো। তাতেই তাদের চেনা যায়। কোনো মুখোশ পরে তারা রাজনীতিতে নামলে মানুষ ভুল করবে। দেশের ও জনগণের লাভ হবে না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা খাঁটি কথা বলে গেছেন, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’

মুমূর্ষু জামায়াতের মঙ্গল-অমঙ্গল নিয়ে বেশি ভাবাভাবি না করে আমাদের কর্তব্য মূলধারার রাজনীতি, যাতে সঠিক ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসে সেই উদ্যোগ নেওয়া। জামায়াতের সংস্কারের চেয়ে জাতীয় রাজনীতির সংস্কার বেশি জরুরি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক

আরও পড়ুন: