চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে তারুণ্যের কর্মসংস্থান

>গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম আলোর আয়োজনে ও ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইডি) সহযোগিতায় ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে তারুণ্যের কর্মসংস্থান’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

আলোচনায় সুপারিশ

* চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে সরকারি-বেসরকারি খাতের নীতি আলোচনা শুরু করা
* যথেষ্ট কর্মসংস্থান ছাড়াই-প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের উদ্যোগ পর্যবেক্ষণ
* কর্মসংস্থান নিয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও তারুণ্যের ইশতেহার বাস্তবায়ন করা
* পরিবর্তনশীল পৃথিবীর আলোকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু
* তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে উৎসাহের সঙ্গে প্রশিক্ষণ, বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত সুবিধা দেওয়া
* সৃজনশীল ও উদ্ভাবনমনস্ক তারুণ্যের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ
* বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থানে অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা
* প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনা তরুণদের নিয়ে। আমরা বর্তমানে অটোমেশনের যুগে প্রবেশ করেছি। যেখানে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গড়ে উঠছে। এখানে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষের কাজ নিয়ে নিচ্ছে যন্ত্র। সময়টা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তরুণদের স্বপ্ন, তাঁদের চাহিদা নিয়েই আজকের এই আলোচনা। কীভাবে তাঁরা এই নতুন যুগের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেবেন। কর্মসংস্থানের জন্য কীভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারেন। তাঁদের ভয় কী। কোথায় তাদের সমস্যা হতে পারে–এসব বিষয়ে আজকের আলোচনা। এখন আলোচনা করবেন সাঈদ আহমেদ।

সাঈদ আহমেদ
সাঈদ আহমেদ

সাঈদ আহমেদ
আইআইডি গত এক মাসে বাংলাদেশের ২৩টি জেলায় একটা জরিপ করেছে। এতে ১১ হাজার ৬৫৮ জন তরুণ-তরুণী অংশ নেন। জরিপের বিষয় ছিল তরুণদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিন্তাভাবনা ইত্যাদি। এতে নানা তথ্য এসেছে।
তরুণ-তরুণীদের শতকরা ৮৪ ভাগ বর্তমানে তাঁদের প্রথম সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের অভাবকে। তাঁদের দ্বিতীয় সমস্যা মাদকাসক্তি। তৃতীয় সমস্যা কাজ করার সুযোগের অভাব।
জরিপে সরকারি উন্নয়ন খাতের মধ্যে এই মুহূর্তে কোনটি বেশি জরুরি—এমন প্রশ্ন করা হয়। এর উত্তরে ৮৭ ভাগ তরুণ-তরুণী বলেছেন শিক্ষার কথা। এ ক্ষেত্রে ৬৬ শতাংশ তরুণ-তরুণী বলেছেন তাঁদের প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় জরুরি বিষয়টি হলো কর্মসংস্থান।
কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্‌গ্রীব তারুণ্যে ভরপুর এই বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রবেশ করছে। এখানে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ছাড়া প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা বর্তমানে তরুণদের প্রধান সমস্যা।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে আমরা একটা অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে প্রবেশ করেছি। অতীতে আমাদের যে ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা ছিল, বর্তমানে তার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করছি।
শিক্ষা তাঁদের কর্মসংস্থান তৈরি করছে কি না, সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
এর জন্য শিক্ষাক্রম প্রণেতা, ব্যক্তি খাত, নীতিনির্ধারক, নাগরিক সমাজ—এই চারটা পক্ষকে একসঙ্গে আনা খুব জরুরি।

অন্দ্রিলা নাজনীন
অন্দ্রিলা নাজনীন

অন্দ্রিলা নাজনীন
লেখাপড়া শেষে একজন তরুণ কাজে যোগ দিতে চান। এর জন্য তিনি কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে যান। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান কর্মী নিয়োগের সময় কাজের অভিজ্ঞতা দেখতে চায়।
কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যাঁরা প্রথম আসেন, তাঁদের কোনো অভিজ্ঞতা থাকে না। সে ক্ষেত্রে তাঁদের কাজ পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
স্কুল-কলেজ থেকেই নির্দিষ্ট কাজভিত্তিক লেখাপড়া করানো উচিত। তাহলে একজন লেখাপড়া শেষ করার পর কাজ পাবেন। ফলে কর্মসংস্থান সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতে পারে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়াশোনা করি, তবে অনুশীলন করি না।
এ ছাড়া আমাদের কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কম। অনেক ক্ষেত্রে এর প্রধান কারণ শিক্ষকদের যথেষ্ট দক্ষতা না থাকা।

মোছা. যারিন তাছনিম স্মরণী
মোছা. যারিন তাছনিম স্মরণী

মোছা. যারিন তাছনিম স্মরণী
দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। তবে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের পক্ষে সবাইকে কাজ দেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। তবে সেখানে আমাদের কিছু সমস্যা আছে। ঋণ–সমস্যা তার মধ্যে প্রধান। উচ্চমূল্যে জামানত দিতে হয়। সুদের হার বেশি। কর ব্যবস্থায় তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা রাখা উচিত। তাহলে বেকার জনগোষ্ঠী উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হবে।
আমাদের এখানকার তরুণদের উদ্ভাবনগুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা সোফিয়াকে আনতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের এক যুবকের বানানো রোবটের জন্য পৃষ্ঠপোষক পাওয়া যায়নি। আমরা যা তৈরি করার সামর্থ্য রাখি, সেখানেই বিনিয়োগ করতে হবে।

কাজী রেজোয়ান হোসেন
কাজী রেজোয়ান হোসেন

কাজী রেজোয়ান হোসেন
আমাদের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই তরুণ। ভবিষ্যতে সংখ্যাটি আরও বাড়বে। আমাদের উচিত এই বিরাটসংখ্যক তরুণকে কাজে লাগানো। তাঁদের সঠিকভাবে ব্যবহার করা।
কাজ না পেলে তরুণদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। কিন্তু তাঁদের হতাশ না হয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানো উচিত। তরুণদের কাজ করতে হবে। সরকার অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। কিন্তু তরুণেরা তা কাজে লাগাতে পারছেন না।
প্রতিবছর দেশে ২৬ লাখের বেশি মানুষ কর্মক্ষেত্রে আসেন। অন্যদিকে কয়েক হাজার বিদেশি আমাদের দেশে কাজ করেন। তাঁরা প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন।
সেই খাতগুলোয় আমাদের লোকবল কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ, তাঁরা দক্ষ নন। তাঁদের দক্ষ না হওয়ার কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তাঁদের দক্ষ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর করতে পারছে না।
আমাদের দেশের শিক্ষক ও উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা যদি যথাযথ প্রশিক্ষিত হন, তবে এসব কাজ তাঁরা নিজেরাই করতে পারবেন। এতে একদিকে যেমন টাকা বাঁচবে, অন্যদিকে আমাদের তরুণেরা কাজ পাবেন।

মো. মিজানুর রহমান
মো. মিজানুর রহমান

মো. মিজানুর রহমান
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশই তার সুযোগ নিয়েছে। তারা তাদের দেশের জনগণকে প্রশিক্ষিত করেছে। তাদের সেই দক্ষ জনশক্তি অন্য দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে।
প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আমাদের এখানে উবার, পাঠাও এসেছে। এতে কাজ করার মতো নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। তরুণেরা এসব জায়গায় কাজ করছেন।
তবে একদিকে তরুণেরা যেমন কাজ পাচ্ছেন, অন্যদিকে কাজ হারাচ্ছেনও অনেকে। ভবিষ্যতে এ রকম অজানা অনেক কাজের ক্ষেত্র সামনে আসবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সেই পরিবর্তনশীল পৃথিবীর কথা মাথায় রাখতে হবে।
সেই অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। যে শিক্ষা তাঁদের উন্নত বিশ্বে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেবে। শুধু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা করলে চলবে না।

আবুল কাসেম খান
আবুল কাসেম খান

আবুল কাসেম খান
আমাদের এখানে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্ভাবন হচ্ছে না। মানসম্পন্ন গবেষণা নেই। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের তলানিতে আছে। আমরা বিদেশ থেকে রোবট আনছি। এটা যে কেউ করতে পারে। এর মধ্যে কৃতিত্বের কিছু নেই। আমাদের উচিত নিজস্ব কিছু তৈরি করা। নিজস্ব কিছু উদ্ভাবন করা।
বাংলাদেশের শিক্ষার গোড়া শক্ত করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের যে পরিবর্তন হবে বলছি, তা অসম্ভব। দরকার হলে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা উচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান তাদের জনগণকে ইংরেজি শেখাতে উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে তারা বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে এসেছিল। আমারও এমন কিছু করতে পারি।
বর্তমান সময়ে ইংরেজি শেখাটা দরকার। সারা বিশ্ব এই ভাষাকে গ্রহণ করেছে। ইংরেজি এখন সারা বিশ্বের ভাষা। আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। তাই বলে আমাদের শুধু বাংলার মধে্যই থাকলে চলবে না।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। আমাদের বৈশ্বিক নাগরিক হতে হবে। এ জন্য ইংরেজিতে দক্ষ হওয়াটা জরুরি।
অনেক বাংলাদেশি বিশ্বের ভালো জায়গায় কাজ করছেন। তাঁদের দেশে আনতে হবে। কর কমিয়ে দিয়ে হলেও তাঁদের দেশে নিয়ে আসা উচিত। তাঁরা তাঁদের বৈশ্বিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
এ ছাড়া আমাদের তরুণেরা তাঁদের অধীন কাজ করে দক্ষ হয়ে উঠবেন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা খুব কম দক্ষ হয়ে উঠছেন। বিশ্বের তুলনায় তাঁরা পিছিয়ে আছেন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত, যেন আমাদের এখানে শিক্ষিত হলে তিনি বিদেশেও কাজ করার সুযোগ পান।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারার মতো শিক্ষাব্যবস্থা করতে হবে আমাদের। বিশ্বায়নের যুগে কেউ শুধু দেশে কাজ খোঁজার জন্য বসে থাকতে পারে না। তাকে পুরো বিশ্বে কাজ খুঁজতে হবে।

তাহিয়া তাবাস্‌সুম
তাহিয়া তাবাস্‌সুম

তাহিয়া তাবাস্‌সুম
তরুণদের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। আমরা কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি না। আমরা যখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাই, তখন কোনো একটা বিষয়ে আমাদের আগ্রহ থাকে।
কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে আমরা ওই বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাই না। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে যায় একজন শিক্ষার্থীর জীবনে।
আমাদের আরেকটা সমস্যা, আমরা প্রচলিত প্রবণতা অনুসরণ করি। আমাদের নতুন কিছু করার আগ্রহ থাকা উচিত।
বিসিএস ক্যাডার, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার থেকে আমরা বের হতে পারি না। আমাদের উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, এখানে ভালো কিছু করা সম্ভব।

অলিভা রানী শীল
অলিভা রানী শীল

অলিভা রানী শীল
প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তা ছাড়া আমাদের উন্নয়ন সম্ভব না। প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের যথেষ্ট সচেতনতা দরকার। আগে আমরা বিনোদনের জন্য টিভি দেখতাম। বাড়ির সবাই এক জায়গায় আসতাম।
আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হতো। কিন্তু এখন সবার হাতে প্রযুক্তি চলে গেছে। সবাই এটা নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে।
এসব বিষয়ে তরুণদের সচেতন হতে হবে। তরুণদের এ অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। কোনোভাবেই যেন প্রযুক্তির খারাপ প্রভাব তাঁদের ওপর না পড়ে।
একসময় কম্পিউটারে প্রাথমিক ধারণা থাকলে সহজেই কাজ পাওয়া যেত। বর্তমানে শুধু প্রাথমিক ধারণাই না, আরও অনেক বিষয় জানতে হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন বুঝে আমাদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

মো. মিনহাজুল আবেদীন
মো. মিনহাজুল আবেদীন

মো. মিনহাজুল আবেদীন
আন্তর্জাতিক এক জরিপ অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চশিক্ষায় বেকারত্বের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। উচ্চশিক্ষায় আমরা শিক্ষিত হচ্ছি। সনদ নিচ্ছি। তাত্ত্বিক জ্ঞান নিচ্ছি। কিন্তু ব্যবহারিক শিক্ষা পাচ্ছি না।
আমাদের অভিভাবকেরা সব সময় চিন্তা করেন তাঁদের ছেলে চিকিৎসক হবেন। ইঞ্জিনিয়ার হবেন। কিন্তু কেউ যে দক্ষ শ্রমিকও হতে পারেন, এটা কেউ চিন্তাই করতে পারেন না।
ভেবে নেওয়া হয় কিছুটা খারাপ শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন। তুলনামূলক ভালো ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী নন। অভিভাবকদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। মেধাবীদেরও কারিগরি শিক্ষায় আসা দরকার। এদিকে আমাদের অনেক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আমাদের এখানে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত। যেন ওই বিষয়ে কেউ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।

অন্তরা আক্তার
অন্তরা আক্তার

অন্তরা আক্তার
সরকারি চাকরির প্রতি তরুণেরা অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। তবে এমনটা হওয়ার কারণও আছে। এর কারণ সরকারি চাকরিতে সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পাওয়া যায়। তাই সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের এত ঝোঁক। আমাদের উচিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অর্থনৈতিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। ফলে তরুণদের মধ্যে থাকা সরকারি চাকরির প্রতি ঝোঁক অনেকাংশে কমবে।
শিক্ষিত তরুণেরা ছাড়াও আমাদের অনেক কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তাঁদের দক্ষতা আছে। এমন তরুণদের কাজে লাগাতে হবে।
আমাদের উচিত দক্ষতানির্ভর কর্মক্ষেত্র তৈরি করা। যেন যে কেউ তাঁর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। আমাদের সেই সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

মো. মেহেদী হাসান
মো. মেহেদী হাসান

মো. মেহেদী হাসান
আমরা মনে করি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অনেক মূল্য আছে। কিন্তু শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা দেখে তেমনটা মনে হয় না। আমাদের ছোটবেলা থেকে শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হয়। যা পড়ছি তা ভবিষ্যতে কী কাজে দিচ্ছে?
বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং করে তরুণেরা ভালো করছেন। এখানে কাজ করে অনেকে তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছেন।
স্কুলপর্যায় থেকেই আমাদের এ ধরনের কিছু শেখানো উচিত। যাতে ভবিষ্যতে আমাদের চাকরির অনিশ্চয়তা তৈরি না হয়। আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোনো চাকরি করব না। উদ্যোক্তা হব।

মো. সামছুল হোসেন
মো. সামছুল হোসেন

মো. সামছুল হোসেন
তরুণেরা স্নাতক শেষ করার পর কী করবেন, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। এই সময় তাঁদের ওপর অনেক মানসিক চাপ থাকে। চাকরির পরীক্ষা দিতে একজন শিক্ষার্থীর অনেক সময় চলে যায়। এই সময়টায় টাকাপয়সারও সমস্যা থাকে। সব মিলিয়ে এই সময়টায় তরুণদের একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
এর জন্য স্কুল ব্যাংকিং আকর্ষণীয় করতে হবে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই যেন একজন শিক্ষার্থী কিছু টাকা জমাতে পারেন। প্রয়োজনের সময় তিনি তা ব্যয় করতে পারবেন।
বাংলাদেশে কাজের ভিন্নতা নেই। তাই তরুণেরা তাঁদের পছন্দের জায়গায় কাজ করার সুযোগ পান না। বাংলাদেশের তরুণেরা খুব বেশি দক্ষও নন। ফলে তাঁরা ভালো করতে পারেন না। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই একজন শিক্ষার্থীকে দক্ষ হিসেবে তৈরি করতে হবে। প্রথম থেকেই তাঁকে একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য গড়ে তুলতে হবে।

নয়ন কুমার গাইন
নয়ন কুমার গাইন

নয়ন কুমার গাইন
আমাদের পড়াশোনা চাকরিকেন্দ্রিক না। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় যা শিখি, তা চাকরির বাজারে খুব কমই কাজে লাগে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো কাজেই লাগে না। আমাদের চাকরি খুঁজতেই শিক্ষাজীবনের অনেক সময় চলে যায়। চাকরি না পেলে মা–বাবা হতাশ হয়ে যান। আমাদের মা–বাবারা চান তাঁদের সন্তান বড় সরকারি চাকরি করবে। িচকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাঁরা এর বাইরে ভাবতে পারেন না। আমরা কেবল সরকারি চাকরি নিয়েই ভাবি। এ জন্য উদ্যোক্তা হতে পারি না। নতুন কোনো কিছু করার চিন্তা আমাদের অভিভাবকেরা করতে পারেন না।
স্কুলপর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষায় ব্যাপক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ জন্য ইংরেজি শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের স্কুল-কলেজে ভালো করে ইংরেজি শেখানো হয় না। একজন শিক্ষার্থী যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখন তিনি তাঁর এই দুর্বলতা বুঝতে পারেন। কিন্তু তখন তাঁর কিছু করার থাকে না।

মরিয়ম আক্তার
মরিয়ম আক্তার

মরিয়ম আক্তার
বাংলাদেশের তরুণদের অনেকেই বিভিন্ন উদ্ভাবন করেন। তরুণদের এই নতুন উদ্ভাবনগুলোকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি কোনো সংগঠন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আমাদের তরুণদের ধারণাগুলো নিয়ে যায়। এরপর তাদের দেশে তার প্রয়োগ করে। এ বিষয়ে আমাদের নজর দেওয়া উচিত।
আমরা আমাদের কাজ করতে বিদেশি শ্রমিক আনছি। অন্যদিকে আমাদের তরুণেরা কাজ পান না। আমাদের কাজ হবে এসব অদক্ষ তরুণদের দক্ষ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর করা।

এ কে এম ফাহিম মাশরুর
এ কে এম ফাহিম মাশরুর

এ কে এম ফাহিম মাশরুর
বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে অটোমেশন শুরু হয়েছে। মানুষের কাজ যন্ত্র করে দিচ্ছে। তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এটা ভবিষ্যতে অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে।
বর্তমানে এমন যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষ ছাড়াই কাপড় তৈরি করা যাবে। আমাদের মতো জনবহুল দেশগুলোতে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে আমাদের দেশে পোশাকশিল্প এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যন্ত্র যখন মানুষের কাজগুলো করা শুরু করবে, আমাদের মতো জনবহুল দেশগুলোর শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি বিষয় থাকা দরকার—সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জটিল সমস্যা সমাধানে সক্ষমতা ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা। এগুলোকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু এগুলোর প্রয়োজনীয়তা সব সময় থাকবে।
প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ার একটা ভয় আছে। প্রযুক্তি এমন একটা মাধ্যম, যা মানুষকেও রোবট বানিয়ে দিতে পারে। ফেসবুকে আপনি কী দেখছেন, তা নির্ধারণ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আপনি কী পছন্দ করছেন কী করছেন না, তা ফেসবুক ঠিক করে দেয়। কোন বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন, কার সঙ্গে করবেন না, তা–ও ফেসবুক ঠিক করে দেয়। ভবিষ্যতে এখানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ আসবে।
আমরা একসময় উপনিবেশের শিকার হয়েছিলাম। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। বর্তমানে আমাদের নতুন উপনিবেশবাদের মোকাবিলা করতে হবে। এটা হবে ডিজিটাল উপনিবেশবাদ।
পৃথিবীর চারটি বড় কোম্পানি ফেসবুক, গুগল, আমাজান, আলিবাবা। এই কোম্পানিগুলোর হাতে অনেক ডেটা আছে। পৃথিবীর অনেক মানুষের তথ্য তাদের হাতে রয়েছে। হতে পারে এই কোম্পানিগুলো পৃথিবীর লোকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করবে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে। তখন দেখা যাবে আমরা আরেকটা বড় উপনিবেশবাদের মধ্যে পড়ব।
পৃথিবীর সব সম্পদের মালিকানা এই কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাবে। আর আমাদের ব্যবহার করবে তাদের স্বার্থে। এসব বিষয়ে তরুণদের চিন্তা করতে হবে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার মতো পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে।

মো. আজিজুর রহমান
মো. আজিজুর রহমান

মো. আজিজুর রহমান
আমরা ২০১০ সলের শিক্ষানীতির ওপর ভিত্তি করে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম তৈরি করি। এই শিক্ষাক্রমের ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে নতুন পাঠ্যপুস্তক আসে।
আমাদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালো নাগরিক ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি। কিন্তু কিছু জায়গায় আমরা এ লক্ষ্য পূরণ করতে পারছি না। তবে আমাদের কারিকুলামের অগ্রগতি খুব ভালো।
পাঠ্যক্রম পরিবর্তন কিংবা পরিমার্জন করার জন্য আমরা জরিপ করে কাজ করি। আমাদের দেশে ৩০ হাজার মাধ্যমিক স্কুল আছে। এগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে পরিদর্শন করি। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সবার সঙ্গে কথা বলি।
চাকরিদাতারা কী চায়, তা জানার চেষ্টা করি। আমরা বিভিন্ন দেশের শিক্ষাক্রম দেখি। এসব সমন্বয় করে কাজ করি। সবার সঙ্গে কথা বলি। তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিই। সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক।
সরকার ই-লার্নিংয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ইতিমধ্যে ৬৪০টি বিদ্যালয়ে ই-লার্নিং ক্লাস পাইলটিং ভিত্তিতে শুরু করা হয়েছে। আস্তে আস্তে তা সারা দেশে চলে যাবে।
আইসিটি শিক্ষার প্রসার বাড়ছে। সরকার এদিকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। আমরা পরিমাণের পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত দিকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এসডিজি বাস্তবায়নে ২০৩১ সালের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা তরুণদের চিন্তাভাবনাগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছি। এখানে অনেক করণীয় বিষয় এসেছে।
আমাদের তরুণদের এগিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা আছে। তাঁদের এই মনোবল আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন
মো. আজিজুর রহমান: শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা

আবুল কাশেম খান: সাবেক সভাপতি ও পরিচালক, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

এ কে এম ফাহিম মাশরুর: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিডি জবস; পরিচালক, বেসিস

সাঈদ আহমেদ: নির্বাহী প্রধান, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি)

অন্দ্রীলা নাজনীন: ফ্যাসিলিটেটর, অ্যাকটিভ সিটিজেনস, খুলনা

কাজী রেজোয়ান হোসেন: সাধারণ সম্পাদক, ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ, পটুয়াখালী

মোছা. যারিন তাছনিম স্মরণী: সভাপতি, প্রজেক্ট উচ্ছ্বাস, বগুড়া

মো. মিজানুর রহমান: জেলা কমান্ডার, পরিবর্তন চাই, বগুড়া

অলিভা রানী শীল: ফেলো, ইয়ুথ ফর পলিসি, দিনাজপুর

মো. মিনহাজুল আবেদীন: ফেলো, ইয়ুথ ফর পলিসি, রাজশাহী

অন্তরা আক্তার: ট্রেনিং ফ্যাসিলিটেটর অব ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার, বরিশাল

মরিয়ম আক্তার: স্বেচ্ছাসেবক, লাল–সবুজ সোসাইটি, বরিশাল

মো. সামছুল হোসেন: জেলা সমন্বয়কারী, সিরাক বাংলাদেশ, সিলেট

নয়ন কুমার গাইন: ফেলো, ইয়ুথ ফর পলিসি, যশোর

তাহিয়া তাবাস্‌সুম: ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ, কমিটি মেম্বার, খুলনা

মো. মেহেদী হাসান: সভাপতি, ভিবিডি, ঝিনাইদাহ

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো