জাতীয় পর্যায়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি চাই

বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে পদার্পণ করেছে। আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলি, সেটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেই ধারণ করে। স্বাভাবিকভাবেই এই যুগের ধারায় ভাষা, বিশেষভাবে মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান-ভাবনা নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। এটা তো আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু এ জন্য যে জাতীয় পর্যায়ে অন্তত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দরকার, সেটা নিয়ে কতজন ভাবি? সে কথায় পরে আসছি। মানুষ মাতৃভাষার মাধ্যমেই কেবল সবচেয়ে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা ও মনের কথা প্রকাশ করতে পারে। এ বিষয় নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। মাতৃভাষার এত গুরুত্ব এই জন্য যে পূর্ণাঙ্গ শিশু হিসেবে জন্মলাভের আগে থেকেই তার মধ্যে মাতৃভাষার ভিত্তি রচিত হতে থাকে। মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বিকাশের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেল বিভক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় নার্ভ সেল। এই সেলগুলোই পর্যায়ক্রমে নার্ভাস সিস্টেম গঠনে সাহায্য করে এবং এ সময়ই স্পর্শানুভূতির প্রারম্ভিক সূচনা ঘটে। এসব নার্ভ সেলই মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য অঙ্গগুলো (ভাইটাল অর্গানস) গঠনের কাজ শুরু করে। মাতৃগর্ভে পঞ্চম বা ষষ্ঠ সপ্তাহে মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জু গঠিত হতে শুরু করে। মস্তিষ্ক গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে শিশুটি জন্ম নিতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে মায়ের চিন্তাভাবনা ও আবেগ-অনুভূতির আত্মিক সংযোগ স্থাপিত হয়।

শিশু জন্মলাভের পর থেকে দেখে, মা তার সঙ্গে কথা বলছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে বুঝতে পারে মায়ের কোন কথায় সে হেসে আনন্দ প্রকাশ করবে, কোন কথায় আপত্তি জানাবে। শিশু কথা বলতে শেখার আগে থেকেই কার্যত মনের ভাব বিভিন্ন ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে। এখানেই মাতৃভাষার গুরুত্ব। শিশু মাতৃভাষা সবচেয়ে সহজে আয়ত্ত করে এবং এটা তার একেবারে আপন ভাষা। সুতরাং মাতৃভাষায় একজন শিশু সবচেয়ে ভালোভাবে জানতে, বুঝতে ও চিন্তাভাবনা করতে পারে।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে শিশু অনেক বেশি চৌকস হয়। চট করে সবকিছু বুঝতে পারে। সব ক্ষেত্রে অনায়াসে সে এগিয়ে যেতে পারে। তার ব্যক্তিত্ব সবাইকে আকৃষ্ট করে। এর কারণ কী? আসল কারণ হলো যে শিশু মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করে, তার পক্ষে অন্য একটি বা দুটি বিদেশি ভাষা শেখা অনেক সহজ হয়। এর ফলে সে সহজে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারে ঢুকতে পারে।

আরেকটি ব্যাপার আছে। আমরা হয়তো অনেকে জানি না যে মাতৃভাষায় দক্ষতা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিরাট অবদান রাখে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা বলছেন, মাতৃভাষায় সুন্দরভাবে পড়তে পারে—এমন শিশুর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে। সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে—এমন একটি শিশু যদি মিনিটে অন্তত ৪০টি শব্দ, মানে মাত্র দেড় সেকেন্ডে একটি শব্দ ভালোভাবে পড়তে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সেই শিশু পঠন-দক্ষতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

আর এ রকম পড়তে পারা শিশুর সংখ্যা যদি মাত্র ১০ শতাংশ বাড়াতে পারি, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারব শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। যদি ১০০ শতাংশ বাড়াতে পারি, তাহলে বাড়বে ৩ শতাংশ। তাহলে বুঝুন, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাতৃভাষার গুরুত্ব কত বেশি। মাতৃভাষায় দক্ষতা ও প্রবৃদ্ধির এই আন্তসম্পর্কের তথ্য জানিয়েছেন ইউএসএআইডির বাংলাদেশে শিক্ষাবিষয়ক টিম লিডার কেট মেলনি। ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারি ইউএসএআইডি ও সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আমরা মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেখানে তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি হিসাব।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ সেদিন তাঁর গবেষণা প্রবন্ধে জানিয়েছেন, আমাদের শিশুদের মাতৃভাষা বাংলায় পঠন-দক্ষতা যাচাইয়ের এক সরকারি জরিপের ফল অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের মাত্র ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিকভাবে বাংলা পড়তে পারে। সত্যিই দুঃখজনক। অথচ একটু চেষ্টা করলেই দক্ষতা ১০০ ভাগ করা যায়। এ জন্য কী করতে হবে? আমরা একটা কাজ করতে পারি। মোবাইলে এমন কিছু বাংলা অভিধান অ্যাপের ব্যবস্থা করতে পারি, যেন সেখানে শব্দের অর্থ তো থাকবেই, পাশাপাশি নির্দিষ্ট বোতাম টিপলে সঠিক উচ্চারণ শোনা যাবে। এ রকম ইংরেজি অভিধান আছে। স্মার্টফোনে আমরা সবাই অ্যাপগুলো ব্যবহার করি। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে শিশুদের জন্য খেলার ছলে মাতৃভাষা বাংলা শব্দের সঠিক উচ্চারণ শেখানোর ডিভিডি সহজলভ্য করা যেতে পারে। রেডিও-টিভির বিশেষ অনুষ্ঠান থাকতে পারে, যেখানে বাংলা শব্দের সঠিক উচ্চারণ শেখানো হবে। এভাবে আমরা মাতৃভাষা বাংলায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারব, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে।

মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের গুরুত্ব তো বুঝলাম। এ জন্য বিজ্ঞানচর্চা বাড়াতে হবে। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো নিয়ে লেখালেখির সমস্যা এখন বড় হয়ে সামনে এসেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে–বুঝতে হলে মূলত ইংরেজি ভাষা লাগে। এমন কিছু বিদেশি শব্দ আছে, যার বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া কঠিন। যেমন অক্সিজেন। এটা তো বলতে গেলে বাংলা শব্দই হয়ে গেছে। কেউ যদি একে বলি অম্লজান, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয়। ‘নেগেটিভ চার্জ’-কে যদি বাংলায় বলি ‘অপরা আধান’, তাহলে বুঝতে কষ্ট হয়।

তাই জাতীয় পর্যায়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হোক। বাংলা একাডেমি সে উদ্যোগ নিতে পারে। বছরে অন্তত একবার কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নেবে বিজ্ঞানের কোন কোন বিদেশি শব্দকে আমরা বাংলা ভাষায় আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে নিতে পারি। তাহলে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা অনেক সহজ হবে।

আমরা জানি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ রকম কমিটি আছে, যারা চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, নতুন কোনো বিদেশি শব্দকে ইংরেজি শব্দ হিসেবে অভিধানে স্থান দেওয়া যায় কি না। এভাবে ইংরেজি ভাষা প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমরাও সে রকম উদ্যোগ নিতে পারি।

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক