এটা কি মৃত্যু, নাকি পরিকল্পিত হত্যা?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এবারের নতুন বছর শুরু হয়েছে শ্রমিকের রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে। সেই রক্তপাত যে তাঁদের জীবনের মতোই মূল্যহীন, তা বছরের শুরুতেই আরও একবার আমাদের দেখতে হলো।

সাভারে গত ৮ জানুয়ারি গুলিতে প্রাণ গেল পোশাককর্মী সুমন মিয়ার। যেহেতু পোশাক খাত একটি আনুষ্ঠানিক খাত এবং সেই খাতের কর্মী সুমন প্রকাশ্যে খুন হয়েছেন, তাই তাঁর লাশে একটা নম্বর পড়েছে। পকেটে পরিচয়পত্র থাকায় তাঁর বয়সটাও আমরা জানতে পেরেছি। ২২ বছরের তরুণ সুমন কাজ করতে ঢাকায় এসেছিলেন। চুরিচামারি, দালালি, ইয়াবাবাজি বা চাঁদাবাজির পথে না গিয়ে তিনি সততার সঙ্গে জীবনযাপন করার জন্য একটু নিশ্বাস নেওয়ার মতো ন্যায্য মজুরি চেয়েছিলেন। সেই চাওয়ার ‘অপরাধে’ তাঁকে গুলি খেতে হয়েছে।

সুমন কার গুলিতে মারা গেছেন—এখন আমাদের তাই নিয়ে তর্ক করতে হচ্ছে। তবু ভালো, সাদত মান্টোর গল্পের মতো সুমনের মৃত্যু নিয়ে এখনো প্রশ্ন ওঠেনি, ‘ওটা মৃত্যু না আত্মহত্যা?’ যার গুলিতে সুমনের মৃত্যু হলে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, প্রাইভেট নিরাপত্তাকর্মীদের কাউকেই ঝামেলায় পড়তে হবে না, তার (অজ্ঞাতপরিচয়ের দুর্বৃত্ত) গুলিতেই তিনি মরেছেন বলে আমাদের মেনে নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

সুমন তো তবু আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মী। তাই তাঁর মৃত্যু অন্তত স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মী নন, যাঁরা দিনমজুরি করেন, তাঁদের মৃত্যুটা কে স্বীকার করবে?

১৫ জানুয়ারি চরম অমঙ্গলের দিন হয়ে যায় পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার মণ্ডুমালা গ্রামের মানুষের জন্য। ভাঙ্গুড়া আর সিরাজগঞ্জের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের একটি দল মুন্সিগঞ্জে এসেছিল কৃষিমজুর হিসেবে কাজ করার জন্য। এক নৌকায় ৩৪ জন যখন মেঘনা নদীতে, তখন তেলবাহী ট্যাংকারের ধাক্কায় শ্রমিকদের নৌকাটি ডুবে যায়। সেই থেকে ২০ জনের কোনো খোঁজ নেই। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জনেরই বাড়ি মণ্ডুমালা গ্রামে। যে ১৪ জন অন্য নৌকার লোকদের সাহায্যে বেঁচে যান, তাঁরা জল পুলিশের কাছে বাকিদের উদ্ধারের আরজি জানালে তাৎক্ষণিকভাবে তা গ্রাহ্য করা হয়নি। পরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের নানা তদবিরে দুই দিন পর কথিত উদ্ধার অভিযান হয়। এতে কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। লাশ না পেলে কর্তৃপক্ষ কাউকে মৃত ঘোষণা করতে পারে না। আর মৃত ঘোষিত না হলে তাঁর পরিবার ক্ষতিপূরণ দাবিও করতে পারে না। ফলে এই নিখোঁজ শ্রমিকেরা মৃত্যুর স্বীকৃতি ছাড়াই নদীবক্ষে হারিয়ে গেলেন।

উত্তরবঙ্গের খেটে খাওয়া মানুষের আরেকটি দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গত ২৫ জানুয়ারি ভোররাতে। নীলফামারীর জলঢাকা থেকে আসা দলটি কাজ
করত কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ঘোলপাশা ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের মেসার্স কাজী অ্যান্ড কোং নামের ইটভাটায়।

ভাটার একটি অস্থায়ী ছোট্ট ঘরে ১৮ জন মানুষ সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর এই ঠান্ডার মধ্যে স্রেফ খড় বিছিয়ে মাটিতে ঘুমিয়ে থাকতেন। ছয় মাসের চুক্তিতে এসেছিলেন এসব শ্রমিক। এক রাতে কয়লার ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে ১৮ জনের মধ্যে ১৩ জনই ইহজাগতিক সব চুক্তি বাতিল করে পরজগতে চলে গেলেন।

বেঁচে যাওয়া একজনের বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁরা ঘুমিয়ে ছিলেন। একটি ট্রাক ভোরে কয়লা নিয়ে আসে। কয়লা আনলোড করার সময় ট্রাক উল্টে তাঁদের ঘরের ওপর পড়ে। গণমাধ্যমের কর্মীরা বলছেন, ভাটার বাদ পড়া ইট দিয়ে কোনোমতে সাজানো হয়েছিল ঘরের দেয়াল। লেবার সরদার বলেছেন, তাঁরা শ্রমিক
হওয়ায় মালিকেরা দায়সারাভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ভাটার মালিক বলছেন, ‘ব্রিক ফিল্ডে শ্রমিকের প্রয়োজন হলে আমরা সরদারের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাদের শ্রমিক সংগ্রহ করে দেন। কিন্তু তারা কোথায় কীভাবে থাকত, সে বিষয়ে আমি জানি না।’

এ ঘটনায় দু-দুটো তদন্ত কমিটির ঘোষণা এসেছে। পুলিশ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দুর্ঘটনার কারণ ও ভাটা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে কি না, তা কমিটি খতিয়ে দেখবে। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক গঠন করেছেন চার সদস্যের তদন্ত কমিটি। তারা দুর্ঘটনার কারণ জানাবে। কেন দুটো কমিটি? কমিটির তদন্তে আসলে কী হবে?

খেটে খাওয়া মানুষের নিরাপদ যাতায়াত আর রাতযাপনের দায়িত্ব কি কোনো কমিটি নেবে? যাত্রীবাহী নৌকা ডুবিয়ে পালিয়ে যাওয়া তেলের ট্যাংকার কেউ খুঁজে বের করবে? ভাটার মালিকদের হাতে জিম্মি শ্রমিকদের দাসদশা থেকে মুক্ত করবে এমন কোনো কমিটি কি আছে?

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক