একুশে আমাদের পথ হারাতে দেবে না

একুশে কথাটার তাৎপর্য অনেক। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হওয়ায় সেই চেতনার ব্যাপ্তি আরও বেড়েছে, তার গণতান্ত্রিক তাৎপর্য আরও স্পষ্ট হয়েছে।

একুশে নিশ্চয়ই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসাকে নবায়িত করে। ভালোবাসাও চর্চা করার বিষয়। ভালোবাসা চর্চা না করলে মরে যায়। মায়ের প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা, সেটাও কিন্তু প্রতিনিয়ত কথায়–কাজে সজীব রাখতে হয়। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসাও আমাদের কাজের মাধ্যমে, কথার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। সেই কবে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা, আজও সেই কথাটা যেন প্রাসঙ্গিক মনে হয়। মাতৃভাষা যেন আমাদের সৎমা হয়ে যাচ্ছে। অথচ পৃথিবীতে যেসব দেশ উন্নত হলো, চীন, জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি—সবাই মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরেই হলো।

বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের করণীয় আছে প্রচুর, কিন্তু এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষ, তারা এই ভাষায় কথা বলে বলেই এই ভাষা বেঁচে আছে। সংস্কৃতে কেউ কথা বলে না, লাতিনে কেউ কথা বলে না বলে সেসব বেঁচে নেই। আমাদের প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়; আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এদের প্রায় সবাই, ধরা যাক, ৩ কোটি ৯৮ লাখই বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করে। তারা বাংলায় পড়ে, বাংলায় লেখে, বাংলায় কথা বলে। আমি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নোবেল পুরস্কার ভাষণ থেকে অনেকবার উদ্ধৃতি দিয়েছি, কিন্তু এটা এমন একটা কথা যা আমাদের বারবারই নিজেদের শোনাতে হবে।

উইলিয়াম ফকনারকে উদ্ধৃত করে নোবেল পুরস্কার ভাষণে মার্কেস বলেছিলেন, ‘মানুষের অবসান মেনে নিতে আমি অস্বীকার করি।’ তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত দমনপীড়ন, নির্যাতন, লুটতরাজ, আত্মবিক্রয় সত্ত্বেও আমাদের উত্তর হচ্ছে: জীবন। না বন্যা, না মহামারি, না বুভুক্ষা, না প্রলয়ঝড়, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে চিরকাল বয়ে চলা যুদ্ধবিগ্রহেও মৃত্যুর ওপর জীবনের নাছোড় প্রাধান্যকে হ্রাস করে দিতে পারেনি।’ তিনি বলেছিলেন, লাতিন আমেরিকায় প্রতিবছর এত শিশু জন্মায় যে তা এক বছরেই নিউইয়র্কের জনসংখ্যাকে ছয় গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রথম শ্রেণিতে যত ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়, ইউরোপের বহু দেশে তত মানুষই নেই। বাংলা মাধ্যমে পড়া কোটি কোটি শিক্ষার্থী এই দেশকে ভবিষ্যতেও নেতৃত্ব দেবে। এদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের একটা বড় কর্তব্য।

একুশের চেতনা ভীষণভাবে গণতান্ত্রিক এবং মানবিক। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে যখন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান, তখন তিনি বলেছিলেন, এটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা। ওই সময় পাকিস্তানে ৬১ ভাগ কথা বলতেন বাংলায়। আর বাকি ৩৯ জনের ভাষা ছিল বিভিন্ন কিছু। উর্দু খুব কমসংখ্যকেরই মুখের ভাষা ছিল। তা সত্ত্বেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে যেন বাংলাকেও রাষ্ট্রের কাজের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকারি কাগজপত্রে—মুদ্রায়, নোটে, মানি অর্ডার ফরমে, ডাকটিকিটে—বাংলা ভাষা অবহেলিত, তাতে জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষারূপে রাষ্ট্রভাষার সম্মান বাংলার প্রাপ্য।

আজকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাদের আর বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না যে একুশের চেতনা মানে কেবল বাংলাকে ভালোবাসা নয়, প্রত্যেকের মাতৃভাষাকে সম্মান জানানো। আমাদের দেশে বাংলা ছাড়াও অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মাতৃভাষাকেও আমাদের ভালোবাসা এবং সম্মান জানাতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে এই কথাটার একটা প্রায়োগিক মানে আছে, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’

একুশের চেতনা মানে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা। একুশে আঘাত করেছিল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের মর্মমূলে, যে পাকিস্তান কেবল রাষ্ট্রই ছিল না, ছিল একটা ধারণাও। যার মূলে ছিল মিলিটারিতন্ত্র, সামন্তবাদ এবং ধর্মের নামে ভেদাভেদ।

একুশে মানে মাথা নত না করা। এটা সর্বার্থে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে আমরা পাই—চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির, সে কথাটাও এই প্রসঙ্গে এসে যায়। আমাদের ভয়হীন একটা স্বদেশ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে প্রতিটা নাগরিকের মাথা থাকবে উঁচু। তাই তো সব সময় বলি, ভয় দেখিয়ে যেন শাসন করবার চেষ্টা না করা হয়, জয় দেখিয়ে যেন করা হয়। ১৯৫২ সালে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ, তারা মাথা নত করতে রাজি হয়নি। তারা গুলি খেয়েছে, জীবন দিয়েছে, কিন্তু মাথা নত করেনি।

একুশের চেতনাই আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একুশের চেতনা মানে গণতন্ত্র। একুশের চেতনা মানে বৈষম্যমুক্তি। একুশের চেতনা মানে বাক্‌স্বাধীনতা। একুশের চেতনা মানে প্রতিটা নাগরিকের সমান মর্যাদা। আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। আমাদের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। তেমনি আজও একুশে আমাদের বাতিঘরের মতো পথ দেখায়। আমাদের বলে যে তোমরা ভুল পথে যেয়ো না।

একুশে আছে বলেই এত বড় বইমেলা হয়। বইমেলাতে যায় যায় লাখ লাখ মানুষ। বাবা-মা তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে যান বইমেলায়। তারা বই দেখে, বই কেনে। নাই নাই করেও আমাদের বইমেলায় আছে প্রচুর ভালো বই। আছে প্রচুর ধ্রুপদি সাহিত্য। এই বইমেলায় যেমন আছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই, তেমনি আছে সমকালীন ধ্রুপদি বইসমূহ—সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই। আবার এই বইমেলায় ছোট-বড় প্রকাশকদের এত চমৎকার সব বই আছে যে আমি তালিকা করে শেষ করতে পারছি না। শুধু প্রথমা প্রকাশনীর নতুন বই আকবর আলি খানের দুর্ভাবনা ও ভাবনা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, আলতাফ পারভেজের যোগেন মণ্ডলের বহুজনবাদ ও দেশভাগ, মোহাম্মদ আজমের বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার, মামুন আল মোস্তফার লালনের রাজনীতি, সাদত হাসান মান্টোর অনুবাদ কালো সীমানা, আজিজুর রহমান খানের আমার সমাজতন্ত্র, নাজিম হিকমতের অনুবাদ জীবন বড় সুন্দর, ব্রাদারসহ যেসব বই কিনেছি, তাতে সামনের দিনগুলো যে পঠনে এবং চিন্তনে বেশ ভালো যাবে, তা ভেবে আমার তো এখনই মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। বইবিমুখ বাঙালিকে বইমেলার মতো এত বড় একটা উপলক্ষ দিয়েছে একুশে, দিয়েছে ভাষা নিয়ে আমাদের কর্তব্যগুলো মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য একটা মাস। এর একটা সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক সুফল আছে।

একুশে আমাদের তাই পথ দেখিয়ে এসেছে, দেখিয়ে যাবে। আমরা যদি এক দিনের জন্যও বাঙালি হয়ে উঠি, তারও একটা সুফল পাওয়া যাবে। আনুষ্ঠানিকতাও মূল্যবান। আসলে আমাদের বাঙালিত্ব কিংবা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তো আমরা মুছে ফেলতে পারব না। সৈয়দ শামসুল হক বলতেন, জাতীয়তা তো একটা জামা নয় যে একটা খুলে আরেকটা পরে নিলেই হলো। আমরা পাসপোর্ট বদলাতে পারব, নাম বদলাতে পারব; বাঙালিত্বের যে জিন নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, সেটা আর কোনো দিনও আমরা বদলাতে পারব না। এমনকি ব্লিচ করে যদি গায়ের রং পাল্টে ফেলি, তা–ও না।

এটা নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের খুব দুশ্চিন্তা ছিল। তাঁরা আমাদের নীচ ভাবতেন। ইতর ভাবতেন। আমরা কেন বাংলা ভাষা ছাড়তে চাই না, কেন রবীন্দ্রনাথ ছাড়তে চাই না, এই সব নিয়ে তাঁদের কী যে দুশ্চিন্তা ছিল! আইয়ুব খানের ডায়েরিতে সেসব কথা লেখা আছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করে প্রমাণ করেছে, বাঙালিদের বাঙালিত্বকে ধারণ করাটাই স্বাভাবিক ও সংগত ছিল। এখন আমরা সাধনা করছি, একই সঙ্গে বাঙালি হতে এবং বিশ্বমানব হতে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক