বাংলা ভাষা কেন দুয়োরানি হবে?

শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষা হওয়ার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন। কয়েক শতক ধরে অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দিক থেকে বাংলাদেশ পাশ্চাত্যের তুলনায় পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ, একাদশ থেকে চতুর্দশ—এই চার শতাব্দী পশ্চিমারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানচর্চা করেছিল। এর ফলে পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে প্রথমে পুনর্জাগরণ ও পরে শিল্পবিপ্লব হয়েছে। যত রকম যন্ত্র ও প্রযুক্তি আমাদের চারপাশে, সিলিং ফ্যান থেকে মোবাইল ফোন—সবই পাশ্চাত্যের বহু শতাব্দীর জ্ঞানচর্চার ফসল।

যে জাতির জ্ঞান নেই, তার প্রযুক্তিও নেই। যার জ্ঞান ও প্রযুক্তি আছে, সে কামলা খাটায়; যার নেই সে খাটে। আমাদের অশিক্ষিত, অপ্রশিক্ষিত শ্রমিকেরা স্বল্প মজুরিতে বিদেশে গিয়ে কামলা দেন। যে সামান্য টাকা দেশে আসে, জ্ঞান ও প্রযুক্তি আমদানি করতে গিয়ে সেই টাকা আবার বিদেশে ফেরত যায়। যদি এখনো আমরা জ্ঞানচর্চা না করি, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের উত্তর-পুরুষেরা হয়তো কম্বোডিয়া বা মিয়ানমারে গিয়ে কামলা দেবে।

জ্ঞানগত উন্নয়নের সঙ্গে ভৌত উন্নয়নের তফাত আছে। কয়েক দশকে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা অসম্ভব হয়তো নয়, কিন্তু জ্ঞানগত উন্নয়ন সাধন করতে কয়েক শতক একটানা পরিশ্রম করতে হবে। যে দেশে গবেষণা ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি, সে দেশে প্রকৃত গবেষণা হওয়ার কোনো কারণ নেই।

ইংরেজি যদি শিক্ষার মাধ্যম হয়, তবে যত লোক জ্ঞানযজ্ঞে শামিল হবে, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলে সেই সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে। যত বেশি লোক জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হবে, উন্নতমানের বুদ্ধিজীবী-উদ্ভাবক পাওয়ার সম্ভাবনা ততই বেড়ে যাবে। ইতিহাসে যখনই কোনো জাতি উন্নতি করেছে—গ্রিক, রোমান, আরব, রুশ, চীনা—সে জাতি তার মাতৃভাষা—গ্রিক, ল্যাটিন, আরব, রুশ, চীনাকে অবলম্বন করেই উন্নতি করেছে। কখনো দেখা যায়নি একটি জাতি অন্য কোনো জাতির ভাষাকে অবলম্বন করে উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে।

তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসে বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ায় বুর্জোয়া বা অভিজাত সমাজের যে বর্ণনা রয়েছে, সেই সমাজে ফরাসি ভাষার গুরুত্ব রুশ ভাষার তুলনায় বেশি ছিল। কিন্তু বিপ্লবের পরে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রুশকেই রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে সোভিয়েত রাশিয়ায়। চীনে অনেকগুলো ভাষার মধ্যে মান্দারিন একটা উপভাষা মাত্র। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে চীনারা এই উপভাষার ওপর জোর দিচ্ছে। ‘সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাই শিক্ষার মাধ্যম হবে!’—এই সিদ্ধান্ত নিছক আবেগের নয়; এর সঙ্গে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করতে চাওয়াটা মূলত ‘মধ্যযুগীয়’ বদভ্যাস। ইউরোপে, মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে, ১০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে, একদা মৃত লাতিন ভাষাকে ‘লিঙ্গুয়া একাডেমিকা’ করা হয়েছিল। কিন্তু পুনরুজ্জীবিত হওয়ার ২০০ বছর পরেই লাতিন ভাষার পুনর্মৃত্যু হয়েছিল। অর্বাচীন সব ভাষা, যেমন ইংরেজি, ফরাসি কিংবা স্প্যানিশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লাতিন টিকতে পারেনি, কারণ প্রথমত, লাতিন কারও মাতৃভাষা ছিল না এবং দ্বিতীয়ত, ইংরেজি বা ফরাসি মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করত এমন লোকের সংখ্যা লাতিন জানা লোকের চেয়ে ঢের বেশি ছিল। বাংলাদেশেও ইংরেজি আগে-পরে বাংলার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। কিন্তু মাঝখানে আমাদের নীতিনির্ধারকদের অবিমৃশ্যকারিতার কারণে কয়েকটি প্রজন্ম কষ্ট পাবে—আরও অনেক দিন বাঙালি যুবক-যুবতীরা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে কামলা বা বুয়ার কাজ করতে বাধ্য হবে।

যদি আমরা ইংরেজি-শিক্ষণে সর্বশক্তি নিয়োগ করি, তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি ÿক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে হয়তো আমরা ইংরেজি শেখাতে সক্ষম হব। সেই গোষ্ঠীর হাতে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। বাংলাদেশ রাষ্ট্র যদি কখনো of the people, for the people হয়েই যায়, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আপামর জনগণের কথা ভাবতেই হবে। রাশিয়া বা চীনের মতো দেশ সবার কথা কমবেশি ভেবেছে, ভাবছে বলেই নিজ নিজ ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করেছে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাই দেশে দেশে, যুগে যুগে শিক্ষার মাধ্যম হয়েছে।

যদি দুটি গোষ্ঠীকে দুটি আলাদা ভাষা শেখানো হয়, একটিকে ইংরেজি, অন্যটিকে বাংলা, তাহলে বাংলাদেশে দুটি শ্রেণি সৃষ্টি হবে। শ্রেণি মানেই আগে-পরে বৈষম্য, অস্বস্তি, চাপা উত্তেজনা। এর ফলে শ্রেণিসংগ্রাম এবং গৃহযুদ্ধ, যাতে জাতি ও রাষ্ট্রের স্রেফ সময় নষ্ট হবে, অর্থাৎ যে উন্নতি আজ করার কথা, সেই উন্নতি হয়তো আসবে দু–তিন দশক বা শতক পর।

নিউমার্কেটের যে মুদিদোকানে আমি বাজার করি প্রতিদিন, যে মাছ বিক্রেতার কাছে আমি মাছ কিনি, তাঁদের অনেকের ছেলেমেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। তাঁদের এবং সবার ভাব দেখে মনে হয়, বাংলা ভাষা হচ্ছে তিন দিনের পচা ডালভাত আর ইংরেজি হচ্ছে বিরিয়ানি। বিরিয়ানি কে না খেতে চায়? সবাইকে বিরিয়ানি খাওয়ানোর মুরোদ কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আছে? কেউ খাবে, কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না—এসব স্লোগান যাঁরা দিতেন একসময়, তাঁরাই বা আজ কোথায় হারিয়ে গেলেন?

এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে ইংরেজি ভাষা আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের অংশ। বিভিন্ন কারণে গোলকায়িত বিশ্বের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ও লিঙ্গুয়া একাডেমিকা হয়ে ওঠা এই ভাষা আমাদের শিখতে হবে এবং খুব ভালোভাবে শিখতে হবে। ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম না করেও ইংরেজি ভালোভাবে শেখা যায়। শিক্ষা নীতিনির্ধারকদের বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও শিক্ষণের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো এক এক করে সমাধান করতে হবে। শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেই ইংরেজি ও বাংলা ব্যবহারে কমবেশি চৌকস হতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় নয়, মনোযোগ দিতে হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দিকে, কারণ এই দুই পর্যায় শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি। ভাষা শিক্ষা এই পর্যায়েই সম্পন্ন হয় এবং প্রয়োজনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় এবং সম্ভব হলে উত্তর ইউরোপের একাধিক দেশের উদাহরণ অনুসরণ করে সেরা ছাত্রদের সর্বোচ্চ বেতন দিয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পিরামিডের ভিত্তিটা চূড়ার তুলনায় বড় এবং শক্তিশালী ছিল বলেই পিরামিড দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।

শিশির ভট্টাচার্য্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক