প্রতিহিংসায় ছবির প্রদর্শন বন্ধ করলেন মমতা?

বাংলাতে বন্ধ হয়ে গেছে চলচ্চিত্র নির্মাতা অনীক দত্তের ছবি ভবিষ্যতের ভূত-এর প্রদর্শনী।
বাংলাতে বন্ধ হয়ে গেছে চলচ্চিত্র নির্মাতা অনীক দত্তের ছবি ভবিষ্যতের ভূত-এর প্রদর্শনী।

বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। পত্রিকায় শিরোনাম ছিল ‘ব্যতিক্রম হয়ে থাকল বাংলা, এ রাজ্যে অবাধ পদ্মাবত।’ পদ্মাবতী বা পদ্মাবত-এর মুক্তি ঘিরে ভারতে তখন তোলপাড়। শাসক দলের প্রশ্রয়ে উন্মত্ত করণী সেনার তাণ্ডব। চার রাজ্যে মাল্টিপ্লেক্সে বন্ধ প্রদর্শনী। সেদিন কড়া পুলিশ পাহারায় পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পেয়েছিল সঞ্জয়লীলা বানসালির ছবিটি। জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছিলেন, ‘আমাদের রাজ্যে ছবিটি নিয়ে কোনো বাধা নেই। বজরং দল এটা (গোলমাল) করছে। যারা হাঙ্গামা করছে, বিজেপির উচিত তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা।’

আজ সেই বাংলাতেই বন্ধ হয়ে গেছে চলচ্চিত্র নির্মাতা অনীক দত্তের ছবি ভবিষ্যতের ভূত-এর প্রদর্শনী। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল শুক্রবার। ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই তুলে নেওয়া হয় সব মাল্টিপ্লেক্স থেকে। ছবি বন্ধে তৃণমূলের কৌশল উগ্র দক্ষিণপন্থী আরএসএসের কৌশলকেও ছাপিয়ে গেছে। বিভিন্ন থানা থেকে হলমালিকদের ফোন করে বন্ধ করা হয়েছে প্রদর্শন। কোনো কারণ দেখানো হয়নি। উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার নামীদামি মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে ছবি বন্ধের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে মিলেছে একটিই উত্তর, ‘হায়ার অথরিটির নির্দেশ’।

সেন্সরের ওপরে ফের সেন্সর! সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশনের (সিবিএফসি) ছাড়পত্র নিয়েই ছবিটি মুক্তি পায় রাজ্যের ৪৪টি হলের ৬০টি স্ক্রিনে। ছবিটির উপাদান খতিয়ে দেখে তবেই অনুমোদন দেয় সিবিএফসি; ছবি মুক্তির আগে যা বাধ্যতামূলক। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী সিবিএফসি ছাড়া অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা সরকারি দপ্তরের হস্তক্ষেপই আইনবিরুদ্ধ। বছর দেড়েক আগে পদ্মাবতী নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইট ছিল, ‘পদ্মাবত বিতর্ক শুধু দুঃখজনক নয়, এটা আসলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দলের ছক কষে করা পরিকল্পনা। আমরা এই সুপার ইমার্জেন্সির নিন্দা করছি। চলচ্চিত্রশিল্পের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। এক সুরে প্রতিবাদ জানানো উচিত।’

আর এবার তাঁর দল, তাঁর সরকারের কীর্তিকলাপকে ব্যঙ্গ করে দেখাতে গিয়ে সেই ‘সুপার ইমার্জেন্সি’র কবলে অনীক দত্ত। রাজনৈতিক ব্যঙ্গবিদ্রূপের আড়ালে ভবিষ্যতের ভূত ছবিতে আসলে উঠে এসেছে সমকালের কথা। ছবিতে ঘুরেফিরে ঠাঁই পেয়েছে ‘অনুপ্রেরণা’। এখন রাজ্যের সর্বত্র ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণা’ লেখাটা দস্তুর হয়ে উঠেছে। কিংবা বেআবরু হয়েছে ‘উন্নয়নের কাঁসর ঘণ্টা’। অথবা ‘আমাদের আর কিছু হবে না সেটিং করে নিয়েছি’-জাতীয় (চিটফান্ডের কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআইয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া) সংলাপ। এসেছে ‘মাথায় অক্সিজেন কমে যাওয়া’র মতো বীরভূমের এক দাপুটে তৃণমূল নেতার টুকরো মন্তব্য। নাম না করেই মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করে ছবিতে নিখাদ হাস্যরসেই উঠে এসেছে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছবি এঁকে টাকা রোজগারের অভিজ্ঞতার কথা। যেখানে শিল্পীর ছবির নিচে লেখা থাকবে ‘সততার প্রতীক’। যাঁর সততা প্রতিদিন প্রশ্নের মুখে বিদ্ধ হয়েছে, সেই ক্যাচলাইনকেই বিদ্রূপ করেছেন অনীক।

শাসকের অদ্ভুতুড়ে শাসনব্যবস্থাকে তুলে ধরেছেন ছবির ভাষায়। ক্যামেরার লেন্স-সংলাপে বারবার ব্যঙ্গ করেছেন বাংলার বর্তমান শাসক গোষ্ঠীকে। ছাড়েননি বিজেপি কিংবা বামপন্থীদের। এর জেরেই কি বন্ধ করা হলো অনীকের ছবি? মাস চারেক আগে কলকাতায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নন্দনে এক আলোচনা সভায় নিজের মতামত খোলাখুলি ব্যক্ত করেছিলেন অনীক। তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। সংস্কৃতির পীঠস্থানে শাসক ভজনার বাড়াবাড়ি চলছে এবং এই ‘বাড়াবাড়ি’ অনুচিত।’ অনীকের সেই মন্তব্য নিয়ে তখন শাসক শিবির থেকে পাল্টা কটাক্ষও করা হয়েছিল। তাতেও সেবার দমেননি তিনি। বলেছিলেন, ‘ভাতে মারলে রুটি খেয়ে থাকব।’

অনীকের ছবি কি তাহলে সেই রোষের শিকার? ছবিটি নিখাদই একটি পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। রাজনৈতিক বিদ্রূপ। যেমন ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। যেমন হীরক রাজার দেশে। আর একেই নিতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী। এই ঘটনা অবাঞ্ছিত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এ দেশে প্রতিটি মানুষের অধিকার। মতের সঙ্গে মিললে আপনি মিত্র, না মিললেই শত্রু—এমন চিন্তাধারা কোনো আধুনিক সুস্থ সমাজের পরিচয় দেয় না। মতের অমিল হলেই কাউকে শত্রু হিসেবে দেগে দেওয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দেয় না। শিল্পীর ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আরও বেশি করে অনাকাঙ্ক্ষিত।

ভবিষ্যতের ভূত, অনীক প্রথম নন। সামাজিক মাধ্যমে ব্যঙ্গচিত্র এঁকে জেলে যেতে হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। নিরীহ প্রশ্ন তোলার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজের গায়ে মুখমন্ত্রী অনায়াসে সেঁটে দিয়েছিলেন ‘মাওবাদী’ তকমা। সমাবেশে ধানের দাম নিয়ে অসহায় প্রশ্ন তোলায় জেলে যেতে হয়েছিল শিলাদিত্যকে। অনীক তাই প্রথম নন।

মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং গায়ের জোরে অপছন্দের মতকে দমন করার প্রবণতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তা সে শাসক দলই হোক, অথবা কোনো যূথবদ্ধ গোষ্ঠী।

শান্তনু দে কলকাতার সাংবাদিক