'আগুন আর কতোটুকু পোড়ে?'

রাজধানীর চকবাজার এলাকায় লাগা আগুনের ঘটনায় নিহতদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: দীপু মালাকার
রাজধানীর চকবাজার এলাকায় লাগা আগুনের ঘটনায় নিহতদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: দীপু মালাকার

‘আগুন আর কতোটুকু পোড়ে?
সীমাবদ্ধ ক্ষয় তার সীমিত বিনাশ,
মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস।

আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে
কিছু থাকে,
হোক না তা ধূসর শ্যামল রঙ ছাই,
মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না
কিচ্ছু থাকে না,
খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই।’

কবি হেলাল হাফিজের লেখা এই কবিতার নাম ‘মানবানল’। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ নামের কাব্যগ্রন্থে ছিল এটি। কবিতাটির পঙ্‌ক্তিগুলোর আক্ষরিক অর্থ আজকের সময়ে বড্ড মিলে যাচ্ছে। প্রকৃতির সৃষ্ট ‘আগুন’ হয়তো মেনে নেওয়া যায়, প্রতিরোধের ব্যবস্থাও নেওয়া যায়, আবার দিনশেষে প্রকৃতির ওপর দোষ চাপানোও যায়! কিন্তু মানুষের সৃষ্ট আগুনে যখন মানুষ মরে, তখন তা থেকে সান্ত্বনার উপায় কী? দোষ কাকে দেবেন, নিজেদের? এ ছাড়া আর উপায়ই–বা কী!

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক স্বজনের আহাজারি। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক স্বজনের আহাজারি। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

রাজধানীর চকবাজার এলাকায় গত বুধবার রাত ১০টার কিছু পরে আগুন লাগে। ওয়াহেদ ম্যানশনে লাগা আগুন পরে ছড়িয়েছে আশপাশের কয়েকটি ভবনে। জানা গেছে, আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রেহাই পায়নি রাস্তায় থাকা মানুষও। এ ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। হাসপাতালের মর্গে মৃতদেহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কয়েক গুণে বাড়ছে স্বজনদের ভিড়। তাঁদের আহাজারি ও কান্নায় ভারী হয়ে গেছে চারপাশের বাতাস। ধীরে ধীরে এই দীর্ঘশ্বাস চলে যাবে দেশের নানা কোণে, প্রিয়জনের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশ নিয়ে স্বজনেরা ফিরবেন বাড়িতে।

কিন্তু এই দীর্ঘশ্বাস এখানেই শেষ হবে না। যেমনটা হয়নি নিমতলীর বেলায়। প্রায় ৯ বছর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটরার নিচতলায় কেমিক্যালের গুদামে আগুন লেগেছিল। ওই ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যু হয়, দগ্ধ হন কয়েক শ মানুষ। ওই ঘটনার ভুক্তভোগীদের ক্ষত আজও সারেনি, দুঃস্বপ্নে এখনো নিশ্চয়ই তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায় আগুন। এই আগুন কোনো প্রকৃতিসৃষ্ট দাবানল থেকে লাগেনি, একে পেলে–পুষে বড় করেছে মানুষের ভুল ও অসচেতনতা। রাসায়নিকের গুদাম পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে সরেনি। রাষ্ট্র ও সরকারও কোনো গা করেনি, শুধু বাগাড়ম্বর ছাড়া।

পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে সব। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে সব। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নিমতলীর ঘটনায় কারও শাস্তিও হয়েছে বলে জানা যায়নি। চকবাজারের ঘটনায় কী হবে? কেন হবে? এ যে দুর্ঘটনা। বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে এই শব্দটির অর্থ হলো—‘আকস্মিক ও অমঙ্গলকর ঘটনা’। অর্থাৎ ‘দুর্ঘটনা’ এমনই এক ঘটনা যাতে কেউ প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকে না। কিন্তু আদতেই কি তাই? রাজধানীর চকবাজার এলাকায় গেলে, প্রথমেই চোখে পড়বে সেখানকার সরু গলি, যেখানে দিন ও রাতের যেকোনো সময় আপনাকে যানজটে আটকা পড়ে যেতে হতে পারে। সেই জটে আপনার ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্টও হতে পারে। কারণ, সেখানকার বেশির ভাগ রাস্তাতেই পাশাপাশি দুটি গাড়ি বা রিকশা বা অটোরিকশা সমানতালে সহাবস্থান করতে পারে না! সেখানে এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটিতে যাওয়া বিদ্যুতের তারগুলো পরস্পরের সঙ্গে এক অমোচনীয় বন্ধনে জড়িয়ে থাকে, তাদের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বিদ্যুতের পজিটিভ-নেগেটিভে ঝগড়া হয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গও দেখা দেয়। সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আবার সিলিন্ডারে থাকা গ্যাসকে আহ্বান জানায়। সিলিন্ডার ত্রুটিপূর্ণ হলে, তা থেকে গ্যাস বেরিয়ে স্ফুলিঙ্গের আহ্বানে সাড়া দিতেও পারে। আর তাতে উৎসাহ দিতে চারপাশের কিছু ভবনে জমিয়ে রাখা হয়েছে থরে থরে রাসায়নিক দ্রব্য। এবার বলুন, এই কল্পিত ছকে প্রকৃতি কোথায়? সব জায়গায় আছে কেবল মানুষের হাত।

চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। প্রত্যক্ষদর্শীদের নানা রকমের বয়ান শোনা যাচ্ছে। তবে নানা ধরনের বিবরণে ঘুরেফিরে কিছু বিষয় আসছেই। এগুলো হলো—গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ, গাড়ির ধাক্কা, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরণ, রাসায়নিকের গুদামে আগুন ইত্যাদি। আর এই সবের সঙ্গেই মানুষের যোগ আছে। আমরা যদি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে কিছুটা সাবধান থাকি, আবাসিক ভবনে যদি রাসায়নিকের গুদাম না রাখি—তবে কি এ ধরনের দুর্ঘটনার ‘প্রাবল্য’ কিছুটা কমানো যায় না?

মোহাম্মদ কাওসার আহমেদের যমজ দুই শিশু সন্তান। ছবি: দীপু মালাকার
মোহাম্মদ কাওসার আহমেদের যমজ দুই শিশু সন্তান। ছবি: দীপু মালাকার

যায়, বেশ ভালোভাবেই যায়। কিন্তু আমরা তা করি না। নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। ফলে পুরান ঢাকা এলাকায় এবার হলো চকবাজার অগ্নিকাণ্ড, যাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৬৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহতদের অনেকে আছেন আশঙ্কাজনক অবস্থায়। অর্থাৎ নিমতলীর ঘটনায় পুড়ে যাওয়া ১২৪টি প্রাণের মূল্য সরকার দেয়নি, দিইনি আমরাও। তাই প্রবল উপেক্ষায় আমরা চালিয়ে গিয়েছি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। রাষ্ট্রও তখন চোখ বুজে থেকেছে, নাগরিকদের সঠিক পথ দেখানোর কাজটি করেনি।

চকবাজারের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ কাওসার আহমেদের বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর স্বজনেরা। এখন লাশ খুঁজছেন মর্গে। তাঁর যমজ সন্তানেরা যখন বড় হয়ে বাবার অভাব বোধ করে কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারিতে ডুকরে কেঁদে উঠবে, তখন? আমরা কি তখনো বলব যে আমরা জীবনের দাম দিতে শিখিনি? প্রাণের মূল্য তখনো কি স্রেফ সংখ্যার হিসাবেই আটকে থাকবে?

শুরুর মতো শেষটাতেও ফিরে যাচ্ছি কবি হেলাল হাফিজের কাছে—

‘জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল,
কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল?’
- (কোমল কংক্রিট)

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]