গলিটা হয়েছিল আগুনের নদী

পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডস্থল
পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডস্থল

সরু গলিটার দুপাশের ঘরবাড়ি, দোকানপাট পুড়ে কালো হয়ে গেছে, এখানে-ওখানে পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া মোটরসাইকেল, রিকশা, পিকআপ ভ্যান, প্রাইভেট কার ইত্যাদির কঙ্কাল। অগ্নিকাণ্ডের অকুস্থলের খুব পরিচিত দৃশ্য। কিন্তু বাতাসে পরিচিত সেই পোড়া ঝাঁজালো গন্ধটা নেই। বরং তাজা স্পিরিটের গন্ধ, সঙ্গে একটু সুবাসও টের পাওয়া যাচ্ছিল। আশপাশের লোকজনকে ব্যাপারটা ধরিয়ে দিতেই একসঙ্গে কয়েকজন বলে উঠল, ‘বডি স্প্রে,’ ‘আফটার শেভ’। একজন পায়ের দিকে তাকাতে বলল। তাকিয়ে দেখি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দুমড়ানো–মোচড়ানো অনেক ক্যানিস্টার; কোনোটা গায়ে মাখা সুগন্ধির, কোনোটা অ্যারোসলের; ছড়িয়ে আছে অজস্র প্রসাধনীর টিউব। ছোট ছোট খোপের মতো দোকানগুলোর সামনে পড়ে আছে বস্তা; সেগুলো ফেটে বেরিয়ে এসেছে অজস৶ প্লাস্টিকের ‘গুটি’ বা দানা। আরও ভালো করে লক্ষ করে দেখি, আমাদের পায়ের নিচে পিচ বা কংক্রিট নয়, প্লাস্টিকের দানার পুরু কার্পেট। ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানিতে সেগুলো ভিজে হয়েছে মখমলের মতো নরম।

 বডি স্প্রে, আফটার শেভ লোশন, অ্যারোসল, প্লাস্টিকের দানা (প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল)—এসব দাহ্য পদার্থের দোকান ও কারখানায় ঠাসা
চুড়িহাট্টার গলিটা বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিণত হয়েছিল আগুনের নদীতে। এক তরুণ পুরান ঢাকার ভাষায় যা বললেন তাতে বুঝলাম, গলিটার এ-মাথা থেকে ও-মাথা দমকা বাতাসের মতো বয়ে গিয়েছিল আগুনের হলকা। সেই হলকায় আতশবাজির মতো ফেটেছে বডি স্প্রে ও অ্যারোসলের অজস্র ক্যানিস্টার; বিস্ফোরিত হয়েছে হোটেলের রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডার। যেন কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে—তরুণটি বললেন; তিনি নিজে উল্টো দিকে দৌড়ে পালিয়ে বেঁচেছেন, কিন্তু চুড়িহাট্টা মসজিদের কোণের তেমাথায় ওই সময় তীব্র যানজটে যাঁরা আটকা পড়েছিলেন, তাঁদের অনেকের পরিণতি হয়েছে মর্মান্তিক।

আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে, তা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অনেকে বলেছেন, চুড়িহাট্টা মসজিদের কোণে যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পিকআপ ভ্যানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাশের রাজ্জাক ভবনের নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থের গুদামে আগুন লাগে, সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের একটি হোটেল এবং বিপরীত দিকের দোকানগুলোতে; দোকানগুলোর প্রায় সবই ছিল প্লাস্টিকের দানা ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থে ঠাসা। দুই পাশে একটার পর একটা দোকান জ্বলে উঠলে পুরো গলিতে আগুনের ঢেউ বয়ে গেছে। আরেকটি ভাষ্য হলো, রাজ্জাক ভবন নামের চারতলা বাড়িটার পাশের হোটেল থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছিল, সম্ভবত গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে।

আগুনের সূত্রপাত যেভাবেই ঘটে থাকুক না কেন, প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে চুড়িহাট্টার ওই সরু গলিটার যেটুকু দেখা সম্ভব হলো, তাতে আমার মনে হয়েছে, পুরো গলিটাতেই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি খুব বেশি। এমন ঘনবসতিপূর্ণ ঘরবাড়ি, দোকানপাট ইত্যাদি স্থাপনায় ঠাসা শ্বাসরুদ্ধকর ওই গলিটাতে এত বিপুল পরিমাণ দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস ভাগ্যের ওপর ভরসা করে জীবন বয়ে চলা ছাড়া আর কিছু নয়। বুধবার রাতে ওই গলিটার ওপর দিয়ে যে ভয়াল অগ্নি-বিভীষিকা বয়ে গেছে, তেমনটা কেন প্রতি সপ্তাহেই ঘটে না সেটাই বরং আশ্চর্যজনক।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকারই নিমতলীতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল। গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছিল এবং দাহ্য নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থের ইন্ধনে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মতো। আগুন লেগেছিল একটা বাড়ির নিচতলায়, নিহত ব্যক্তিরা ছিলেন বাসাবাড়িগুলোর ভেতরে। কিন্তু গত বুধবার চুড়িহাট্টায় আগুন লেগেছিল গলিতে; মানুষ পুড়ে মারা গেছে রিকশায়, মোটরসাইকেলে, প্রাইভেট কারে, পিকআপ ভ্যানের ভেতরে। সড়কে যানবাহনের দুর্ঘটনায় নয়, পথ চলতে চলতে একসঙ্গে এতজন মানুষের পুড়ে অঙ্গার হওয়ার ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে পড়ে না।

পথচলতি এই দুর্ভাগাদের মধ্যে কজনের স্বজনদের দেখা পেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে। তাঁরা বিনা মেঘে বজ্রপাতে নির্বাক হয়ে গেছেন। তাঁদের মুখ থেকে কথা বের করা দুঃসাধ্য। তাঁরা মাটির দিকে চেয়ে ছিলেন, তাঁদের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, তাঁরা বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ২৪ বছরের তরুণ মাহফুজ বুধবার রাত সাড়ে ১০টার কিছু পরে আগুন লাগার খবর পেয়ে চুড়িহাট্টায় ছুটে গিয়েছিলেন। সেখানে বাবার ভ্যানিটি ব্যাগের কারখানা, বাবা সেখানে আছেন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা মাহফুজকে চুড়িহাট্টায় পৌঁছাতে দেয়নি। তারপর থেকে তিনি সারা রাত ধরে বাবার মুঠোফোন নম্বরে ফোন করেছেন, ফোন বাজেনি। কিন্তু তিনি ফোন করা ছাড়েননি। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ফোন বেজে উঠলে মাহফুজের মনে আশা জেগে উঠেছিল। কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে যখন একটা অচেনা পুরুষকণ্ঠ তাকে বলে, ‘ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আসেন’, তখনই মাহফুজ বুঝে ফেলেছিলেন, বাবা আর নেই।

সাদ নামের এক তরুণ মাটিতে বসে এক হাতে মুখ ঢেকে অন্য হাতে মুঠোফোনে কেঁদে কথা বলছেন। কথা শেষ হলে তাঁর কাছে জানতে পেলাম, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়ন (২৪) চুড়িহাট্টায় এক দোকানের কর্মী। বুধবার রাতে কাজ শেষে ওই গলি দিয়ে ফিরছিলেন, সম্ভবত হেঁটে। মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে সাদের শেষ কথা হয়েছিল রাত ১০টার কিছু পরে। তারপর সারা রাত তাঁর ফোন বাজেনি। এখন তাঁর প্রাণহীন আধপোড়া দেহ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।

কান্নাভেজা চোখে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিন-চারজন তরুণী। তাঁরা বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁদের দুই বন্ধু-সহপাঠী চুড়িহাট্টায় এক ডেন্টাল ডিসপেনসারিতে একজন সিনিয়র ডেন্টিস্টের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতেন। তাঁদের পোড়া মৃতদেহ এখন মর্গে। যে সিনিয়রের কাছে তাঁরা কাজ শিখছিলেন, তিনি সৌভাগ্যক্রমে ওই সময় ডিসপেনসারিতে ছিলেন না।

মোহাম্মদ আরমান নামের এক যুবক মর্গের সামনে মাটিতে বসে ছিলেন থমথমে মুখে। তাঁর আপন চাচা এবং একই সঙ্গে শ্বশুর, ৭০ বছর বয়সী শামসুল হক নিজের ডেকোরেটরের দোকানে ছিলেন; ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা ওই দোকানের ভেতর থেকে উদ্ধার করেছেন ছয়জনের দেহ। তাঁরা পুড়ে এমনই অঙ্গার হয়ে গেছেন যে মোহাম্মদ আরমান তাঁর শ্বশুরকে শনাক্ত করতে পারেননি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে যে ৬৭টি মৃতদেহ রাখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৩৭ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। বাকি মৃতদেহগুলো এমনভাবে পুড়ে গেছে যে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া তঁাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাঁদের সবাই সম্ভবত দগ্ধ হয়েছেন দোকান, হোটেল বা যানবাহনের ভেতরে।

চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে যে ৬৭ জন মানুষ অতি-আকস্মিকভাবে অকালমৃত্যুর শিকার হলেন, তাঁদের স্বজনদের জন্য কোনো সান্ত্বনা, কোনো ক্ষতিপূরণই যথেষ্ট হবে না। তবু হয়তো তাঁদের সান্ত্বনার বাণী শোনানো হবে, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হতে পারে। কিন্তু তার ফলে চুড়িহাট্টার ওই গলিটার (‘বিস্ফোরকের গলি’ বললে ভুল হবে না) মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে বসবাসরত হাজার হাজার, কি লাখ লাখ মানুষের জীবন একটুও নিরাপদ হবে না? চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ড বড্ড মর্মান্তিকভাবে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নিমতলী অগ্নিকাণ্ড থেকে আমরা কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করিনি।

এবার সরকারকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর ঝুঁকি কমানোর উদ্দেশ্যে যেসব করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেগুলোর কতটা বাস্তবায়ন করা হয়েছে বা আদৌ করা হয়েছে কি না। করা না হয়ে থাকলে তার দায় কার।

অতিরিক্ত জনঘনত্বের ঝুঁকিগুলো নিয়েও এখন চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
[email protected]